জুলাই মাসের ৭ তারিখ। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য রাজনীতিবিদের কাছে কল আসে ভারতের +৯১৮০১৭৮২২৭২৫ ডিজিটের একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে। রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘সুব্রত বাইন (পুলিশের তালিকায় মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী) বলছি। কলকাতায় আছি। তিন দিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা রেডি (প্রস্তুত) রাখেন। আমার লোকজন আপনার অফিসে গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। মনে রাখবেন তিন দিন। টাকা দিতে না চাইলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিন।’

এমন ফোন পেয়ে ওই রাজনীতিবিদ নম্বরটিতে কলব্যাক করেন। ফোনটি ‘আনরিচেবল’ বলা হলেও ট্রু কলারে ভেসে ওঠে ‘সুব্রত বাইন’-এর নাম। আতঙ্কিত ওই ব্যক্তি মতিঝিল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। জিডি তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে নতুন তথ্য।
 
কলকাতা থেকে সুব্রত বাইন নয়, বরং ঢাকার গাজীপুর থেকে কয়েকজন প্রতারক মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। এজন্য তারা ব্যবহার করছে ভারতীয় হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর।

সম্পর্ক ছিন্ন হলে তাদের অনেকেই সেসব ছবি দিয়ে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করেন, কেউ আবার টাকা দাবি করেন। এমন অধিকাংশ ঘটনায় আমরা হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার দেখেছি। তারা নিজেদের নয় বরং বিদেশি কোনো নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করছেন

বাংলাদেশে প্রতিদিন অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। সূত্রহীন অপরাধের জন্য অপরাধীরা বেছে নিচ্ছে বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট জানায়, আমাদের কাছে অনেক নারী ভিক্টিম আসেন। সম্পর্ক থাকাকালীন তারা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে নিজেদের সংবেদনশীল মুহূর্তের ছবি শেয়ার করেন। একপর্যায়ে সম্পর্ক ছিন্ন হলে তাদের অনেকেই সেসব ছবি দিয়ে মেয়েদের ব্ল্যাকমেইল করেন, কেউ আবার টাকা দাবি করেন। এমন অধিকাংশ ঘটনায় আমরা হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহার দেখেছি। তারা নিজেদের নয় বরং বিদেশি কোনো নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে এসব অপকর্ম করছেন।

মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার ক্রাইম টিমের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ যদি ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে কাউকে উত্ত্যক্ত বা ব্ল্যাকমেইল করেন, সেক্ষেত্রে আমরা তাদের খুব সহজেই শনাক্ত করতে পারি। এমনকি ফেক অ্যাকাউন্ট দিয়ে এসব কাজ করলেও তাদের ধরা সম্ভব। 

‘বর্তমানে অধিকাংশ অপরাধ হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। অপরাধীরা অ্যাপটিকে অপরাধের জন্য নিরাপদ মনে করেন। হোয়াটসঅ্যাপের সোর্স নম্বর দিয়ে খুব সহজেই অপরাধী শনাক্ত করা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যায় অপরাধীরা বিদেশি নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগতভাবে তাদের শনাক্ত করা একটু জটিল।’

প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিং-এর ঘটনায় অধিকাংশ সময়ই ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নম্বর ব্যবহার করা হয়

ডিবি ও সিটিটিসির সাইবার টিম থেকে জানা যায়, প্রতারণা, চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলিং-এর ঘটনায় অধিকাংশ সময়ই ভারত, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নম্বর ব্যবহার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি গবেষক মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশে হোয়াটসঅ্যাপ চালু রয়েছে। নির্বিঘ্নে ফোন কল ও ম্যাসেজ করা যায় এতে। সেক্ষেত্রে বিদেশি নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারে ক্ষতি ছাড়া উপকারের কিছু নেই। যখনই বিদেশি নম্বর দিয়ে কেউ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করবেন, বুঝতে হবে তার মূল উদ্দেশ্য নিজের আইডেন্টিটি বা পরিচয় গোপন রাখা। পাশাপাশি তাদের অবৈধ কোনো উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।

তিনি আরও বলেন, শুধু হোয়াটসঅ্যাপের ক্ষেত্রে নয়। অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও পরিচয় গোপন রাখা, ভুয়া (ফেক) লোকেশন দেখানোর কাজে বিদেশি নম্বর ব্যবহার হচ্ছে। কারও যদি এমন কোনো উদ্দেশ্য না-ই থাকে তাহলে দেশি নম্বর ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্যান্য অ্যাপ ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়।

পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (এসি) ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকেন। তারা দেশে এসে নিজ নিজ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অনেক সময় বিদেশি সিম ব্যবহার করেন। তাদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা তেমন দেখা যায় না। তবে আমাদের কাছে বর্তমানে অসংখ্য ‘চাঁদাবাজি ও পর্নোগ্রাফি’ সংক্রান্ত ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগ আসছে। এসব অপরাধ হচ্ছে মূলত বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ব্যবহার করে। অধিকাংশ নম্বর ভারত ও মালয়েশিয়ার।

‘কেউ যদি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে অপরাধ করেন অবশ্যই তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ জানিয়ে পুলিশের সাইবার টিমের এ কর্মকর্তার পরামর্শ, কেউ যদি বিদেশি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দ্বারা অপরাধের শিকার হন, তাহলে তাকে সেই নম্বরটির বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। পাশাপাশি দেশের প্রচলিত আইনের আশ্রয় নিতে পারেন তিনি।

যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশ

বিদেশি সিমের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করা অপরাধীরা পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তারা মূলত বিদেশে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের নম্বরে ওটিপি পাঠিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ ইনস্টল করেন। এছাড়া তাদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন কাজে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে দেশে  ফিরে এসেছেন। তারা সে দেশের সার্কেলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য অ্যাপটি মোবাইলে রেখে দেন। তবে বাংলাদেশে এসে কোনো কাজ না পেয়ে কেউ কেউ বিদেশি নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটিত করেন।

বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে বর্তমানে অপরাধীরা চাঁদাবাজি-ব্ল্যাকমেইলিং-এর মতো অপরাধ করছে। তারা যাতে এর চেয়ে বড় নাশকতা বা অপরাধ করতে না পারে সেজন্য এখন থেকেই এ প্রবণতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

এ ধরনের অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সরেজমিনে তদন্তের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত তদন্তও শুরু করেন। সেক্ষেত্রে মোবাইল নম্বরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এমনিতে হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপগুলো অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে। তবে দেশি নম্বর ব্যবহার করলে কিছুটা হলেও তাদের শনাক্ত করা যায়। কিন্তু কেউ যদি বিদেশি নম্বর দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে অপরাধ করেন, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষের কাছে ‘রিপোর্ট’ করা ছাড়া তেমন কোনো পথ থাকে না।

সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে বর্তমানে অপরাধীরা চাঁদাবাজি-ব্ল্যাকমেইলিং-এর মতো অপরাধ করছে। তারা যাতে এর চেয়ে বড় নাশকতা বা অপরাধ করতে না পারে সেজন্য এখন থেকেই এ প্রবণতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এআর/এমএআর/