ইয়াবার মতো দেশে ব্যাপক হারে বিস্তার লাভ করছে ভয়ংকর মাদক ‘আইস’ বা ক্রিস্টাল মেথ। কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে আসছে এ মাদক। চড়া দামে তা বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায়। উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এ মাদক।

দিন দিন আইসের বিস্তার বাড়লেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে অন্য একটি বিষয়। সাধারণত দেশে প্রচলিত মাদকের কারবার হয় কয়েক ধাপে। সীমান্ত এলাকা থেকে একটি দল মাদক এনে তুলে দেন ডিলারদের হাতে। ডিলারদের কাছ থেকে চালান নিয়ে খুচরা কারবারিরা তা ছড়িয়ে দেন সারাদেশে। এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত সেবনকারীদের মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কিন্তু আইসের ক্ষেত্রে ঘটছে উল্টোটা। সীমান্ত থেকে মাদকটি নিয়মিত ডিলারদের হাত ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করলেও এর খুচরা কারবারিরাই মূলত সেবনকারী। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, বনানী, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় প্রায় ১০টির বেশি আইস বিক্রির চক্র রয়েছে। যারা সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, একই সঙ্গে সেবনকারী। তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আইস বিক্রি ও সেবন করেন।

ডিএনসি সূত্রে আরও জানা যায়, গত আগস্টে ৫০০ গ্রাম আইসসহ ছয়জনকে রাজধানীর উত্তরা ও বনানী এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। যাদের মধ্যে তিনজন বনানীর, একজন বারিধারার এবং বাকি দুজন তেজগাঁও ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা। গ্রেফতার হওয়া প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। একই সঙ্গে তারা  আইস সেবনকারী ও কারবারি।

তারা সবাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, বিক্রি করেন আইস–ইয়াবা / ছবি- সংগৃহীত

সর্বশেষ অক্টোবর মাসে রাজধানীর উত্তরা, পল্লবী ও দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫০০ গ্রাম আইসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে ডিএনসি। গ্রেফতারদের মধ্যে একজন টেকনাফের মাদক-কারবারি। বাকি দুজনের মধ্যে একজনের বাড়ি চট্টগ্রামে। তিনি টেকনাফ থেকে ঢাকায় আইস নিয়ে আসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অন্যজন দক্ষিণখান এলাকার বাসিন্দা। যিনি আইস সেবন ও কারবারের সঙ্গে জড়িত।

আইসের ঘাঁটি কেন রাজধানীর অভিজাত এলাকায়

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, আইস মূলত উচ্চ মূল্যের মাদক। যার প্রতি গ্রামের দাম আনুমানিক ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এ মাদক সব শ্রেণির সেবনকারীদের জন্য সহজলভ্য নয়। অন্যদিকে, রাজধানীর অভিজাত এলাকার উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মাঝে আকাশচুম্বী চাহিদা রয়েছে আইসের। এ চাহিদাকে কেন্দ্র করে এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের আড়ালে আইসের বেচাকেনা হয়। বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় প্রায় ১০টির মতো আইস সেবন ও কারবারির চক্র রয়েছে। প্রতিটি চক্রে ১০-১৫ জন করে সদস্য রয়েছেন।

আইসের ব্যবসায় কেন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দাম অনেক বেশি হওয়ায় সব মাদক-কারবারি আইস কিনতে পারেন না। এছাড়া গাঁজা, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের যেসব ডিলার বা কারবারি রাজধানীতে আছেন তারাও অধিক দামের কারণে খুব একটা আইসের ব্যবসা করেন না। যেহেতু দেশে মাদকটির এখন পর্যন্ত একমাত্র গ্রাহক উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা, তাই তারা নিজেদের জোগান ঠিক রাখতে এর কারবারে নেমেছেন। তারা টেকনাফের মাদক-কারবারিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে ঢাকায় আইস নিয়ে আসেন। ঢাকায় আনার পর যেসব সেবনকারী গ্রুপের কাছে আইসের জোগান থাকে না, তখন অন্য গ্রুপ নিজেদের চাহিদা মতো রেখে ওইসব গ্রুপের কাছে বাকি আইস বিক্রি করে দেয়। মূলত এভাবেই রাজধানীতে আইসের ব্যবসা চলে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অভিযানে উদ্ধার হওয়া মাদক আইস ও ইয়াবা / ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে ডিএনসির ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গত কয়েক মাসে রাজধানীতে আইসের সঙ্গে জড়িত এমন বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছি। তাদের অনেককে আমরা গ্রেফতার করেছি। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা প্রায় সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। নিজেদের চাহিদার জোগান ঠিক রাখতে তারা টেকনাফের স্থানীয় মাদক-কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইস নিয়ে আসেন। পরে রাজধানীতে থাকা বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে তা সরবরাহ করেন। এ রকম বেশ কয়েকটি গ্রুপের সন্ধান আমরা পেয়েছি।

নজরদারি এড়াতে সুরক্ষিত অ্যাপের ব্যবহার

ডিএনসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একাধিক বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজধানীতে যারা আইসের কারবার ও সেবন করেন তারা প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক দক্ষ। তারা বিভিন্ন গ্রুপে আইস বিক্রি করতে হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মতো অ্যাপ ব্যবহার করেন। নজরদারি এড়াতে গ্রুপগুলো কখনওই ফোন কলে যোগাযোগ করেন না। প্রযুক্তিগত দিক থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো অনেক সুরক্ষিত। ফলে খুব সহজেই ট্র্যাক করে এসব চক্রের সদস্যদের বিষয়ে তথ্য নেওয়া সম্ভব হয় না।

ডিএনসির ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, নজরদারি এড়াতে তারা এসব অ্যাপ ব্যবহার করে আইসের ব্যবসা করছেন। এজন্যই তাদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে ডিএনসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত একাধিক বাহিনীর সাইবার টিম বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রুপগুলোর কার্যক্রম নজরদারিতে নিয়ে আসছে। ফলে বিভিন্ন সময় এসব গ্রুপের অনেক সদস্যকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।

আইসের সেবন বেড়েছে কয়েক গুণ 

২০১৯-২০ সালে দেশে প্রথম ভয়ংকর মাদক আইসের নাম শোনা যায়। শুরুর দিকে এ মাদকের ব্যবহার কম হলেও বর্তমানে তা বেড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে আইসও ইয়াবার মতো মহামারির আকার ধারণ করবে। এখন যেমন ইয়াবা সেবন বন্ধে প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আইসের ক্ষেত্রেও তেমনটি হবে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বায়িং হাউজের আড়ালে চলে আইসের কারবার, উত্তরা থেকে গ্রেফতার মাদক-কারবারিরা / ঢাকা পোস্ট

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে আইসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে মিয়ানমার থেকে এর চালানও আসছে।

দেশে আইসের প্রবেশ ঠেকানো না গেলে ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

ইয়াবার চেয়েও বহুগুণ ক্ষতি আইসে

বর্তমানে দেশে সবচেয়ে আলোচিত মাদক আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। আইসে ইয়াবার মূল উপাদান এমফিটামিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই মানবদেহে এর প্রভাবও অনেক বেশি। এটি সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা এবং মানসিক অবসাদ ও বিষণ্নতার ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রে এটির নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। 

এ মাদকের ব্যবহারের ফলে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অস্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে আসক্ত হয়ে তরুণরা নানা অপরাধে জড়িত পড়ছেন।

এমএসি/এমএইচএস/এমএআর