অপরূপ সৌন্দর্যের মালদ্বীপ। মহাসাগরের নীলাভ জলরাশি যে কাউকে মুগ্ধ করবে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

প্রতিদিনই মালদ্বীপের উদ্দেশে উড়াল দিচ্ছেন বাংলাদেশিরা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন। তবে অধিকাংশই যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে। অন্য সব দেশে অবৈধ কর্মীদের ‘অবৈধ’ বললেও মালদ্বীপে বলা হয় ‘অনিয়মিত’।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ এসব কর্মী অন্যান্য শ্রমিকের মতো কাজ করার সুযোগ পেলেও ভিসা না থাকায় সুযোগ নেন দেশটির মালিকরা। সুযোগ-সুবিধা দেওয়া তো দূরের কথা, ঠিক মতো বেতনও দেওয়া হয় না তাদের। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে এমন কয়েকজন ভুক্তভোগী প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকের কথা হয়।

তাদের একজন নিয়াজ জামান সজীব (ছদ্মনাম)। তিন বছর আগে ভাগ্য পরিবর্তনে মালদ্বীপে আসেন। রাজধানী মালেতে একটি এলইডি লাইট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। জীবিকার সন্ধানে মালদ্বীপে এসেছি। গত তিন বছরে মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এত ঘন ঘন কাজ পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হলো প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা না পাওয়া।

সাধ্যের মধ্যে ভ্রমণের সব সুখ মেলে মালদ্বীপে। যে কেউ চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন দেশটিতে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, আমরা যারা অনিয়মিত, তাদের সবার পারিশ্রমিক নিয়ে ছলচাতুরী করেন মালদ্বীপের মালিকরা। ২০১৮ সালে মালদ্বীপে এসে চার হাজার মালদিভিয়ান রুফিয়ার (২০ হাজার বাংলাদেশি টাকা) একটি চাকরিতে যোগ দেই। তবে তারা আমাকে কোনো মাসে দুই হাজার, কোনো মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন দিত। কাজের ভিসা না থাকায় চাকরির সময় কোনো কাগজ দেওয়া হয়নি। মুখে মুখে চাকরি, যখন খুশি বের করে দেয়। হাই কমিশনে অভিযোগ দিয়েও কোনো লাভ হয় না।

মালদ্বীপে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। অবৈধভাবে এখানে আসায় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তারা / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশি হাই কমিশনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় ওসমান মাহমুদ জয় (ছদ্মনাম) নামের আরেক প্রবাসীর। তার বাড়ি ফেনী। ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালদ্বীপের কোনো প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি কারও একক মালিকানা থাকে না। স্থানীয় একজনকে পার্টনার হিসেবে রাখতে হয়। এমন দ্বৈত পার্টনারের একটি সুপার শপ প্রতিষ্ঠানে কাজ করি দুই বছর ধরে। আমাকে সাড়ে তিন হাজার রুফিয়া ও দুই বেলা খাবার দেওয়ার কথা। তবে করোনার অজুহাতে কোনো মাসে ৫০০, কোনো মাসে এক হাজার রুফিয়া দেওয়া হয়। বৈধ নয় বলে কারও কাছে অভিযোগ জানাতে পারি না। হাই কমিশনে অভিযোগ দিলেও লাভ হয় না।

মালদ্বীপের একটি মাছের বাজার। নানা ধরনের সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায় এখানে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘ইতোমধ্যে মালদ্বীপে বৈধ হওয়ার জন্য আবেদন করেছি। তবে দেশটির সরকার এখনও আমাদের বৈধ করার প্রক্রিয়া শেষ করেনি। আর হাই কমিশনে অভিযোগ দিলেও তেমন লাভ হয় না। খুবই অল্প সংখ্যক শ্রমিক হাই কমিশন থেকে সহযোগিতা পান।’

গতকাল রোববার (৫ ডিসেম্বর) সরেজমিনে মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনে গিয়ে ১৫-২০ জন প্রবাসী বাংলাদেশির দেখা মেলে। নানা সমস্যা নিয়ে তারা সেখানে ভিড় করেছেন। তাদের অধিকাংশেরই অভিযোগ, ‘মালিক ঠিক মতো বেতন দেয় না।’

বিস্তীর্ণ ভারত মহাসাগরের নীলাভ জলরাশি আকৃষ্ট করে যেকোনো পর্যটককে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

বাংলাদেশ হাই কমিশন সূত্রে জানা যায়, মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। এর মধ্যে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি আছেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিক নেওয়া হলেও ২০১৯ সাল থেকে এ প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে দেশটির সরকার। এরপরও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে গায়ে খেটে, চাকরি অথবা ব্যবসা করে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। প্রতিদিনই ভুক্তভোগী শতাধিক প্রবাসী তাদের সমস্যা নিয়ে হাই কমিশনে আসেন। সবার সমস্যা প্রায় একই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রিয়ার অ্যাডমিরাল নাজমুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মালদ্বীপে প্রায় এক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। এ দেশের সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই অনিয়মিত অর্থাৎ বৈধ ভিসা ছাড়া বসবাস করছেন। এটা সত্যি যে অনিয়মিতদের প্রতিদিনই নানাভাবে ঠকানো হচ্ছে। তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। আমরা নিয়মিত এ ধরনের অভিযোগ পাচ্ছি।

অবৈধভাবে আসায় মালদ্বীপে অবস্থিত বাংলাদেশি হাই কমিশনের পক্ষে প্রবাসীদের জন্য তেমন কিছু করার থাকে না / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

তিনি আরও বলেন, অনিয়মিতদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাদের প্রতিষ্ঠানে ফোন দিয়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক পরিশোধের কথা বলি। তবে এক্ষেত্রে আমাদের প্রচুর বেগ পেতে হয়। মালিকরা আমাদের ফোন পেয়ে প্রায়ই বলেন, শ্রমিকদের অভিযোগ মিথ্যা। তারা নিয়মিত বেতন পরিশোধ করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান বলে, ‘বেতন বা সুযোগ-সুবিধার প্রশ্ন পরে, আপনারা যার অভিযোগের কথা বলছেন সেই নামে আমার এখানে কোনো কর্মী কাজ করেন না।’ মালিকরা এভাবে ভিসা না থাকার সুযোগ নেন।

নাজমুল হাসান বলেন, যেহেতু বাংলাদেশিদের কাছে কোনো বৈধ ভিসা বা নিয়োগপত্রের কোনো কাগজপত্র থাকে না, সেজন্য আইন অনুযায়ী আমরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তেমন কোনো চাপ দিতে পারি না। একপর্যায়ে আমরা তাদের বেতন পরিশোধের জন্য অনুরোধ করি।

বাংলাদেশ হাই কমিশন কার্যালয়ের সামনে সেবা নিতে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন বৈধ প্রবাসীরা

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে বৈধভাবে কাজ করা প্রায় ১০ প্রবাসী বাংলাদেশি মালদ্বীপ প্রশাসনের প্রশংসা করেন। সেখানকার হোটেল এক্সপ্রেস ইননে কাজ করেন বাংলাদেশি শ্রমিক মো. জালাল উদ্দীন। তিনি বলেন, এ দেশের মালিক ও প্রশাসন বাংলাদেশি শ্রমিকদের অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। একজন বৈধ শ্রমিক মালদ্বীপের কর্মীর মতোই সুযোগ-সুবিধা পান। বেতন-বোনাস ছুটিসহ সব ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়। ছোট কাজ করায় আমিরাত-সৌদি আরবে দেখেছি, সেখানে বাংলাদেশিদের তুচ্ছ করা হয়। মালদ্বীপে এমনটি হয় না। তারা আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে।

মালদ্বীপে অবস্থিত একটি ফলের দোকান। টাটকা ও সুস্বাদু ফল মেলে এখানে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

এলিগেন্ট বিচ ফ্রন্ট সুটস নামের একটি হোটেলের অপারেশনাল ম্যানেজার ইয়াসিন আরাফাত সাজন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গত ১১ বছর ধরে এখানে আছি। অনেকেই বলেন প্রবাস জীবনটা কষ্টের। তবে আমার তেমনটি মনে হয় না। এ হোটেলের মালিক মালদ্বীপের নাগরিক। আমি এখানকার প্রধান। আমার অধীনে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শ্রমিকরা কাজ করেন। তারা বাংলাদেশিদের অনেক সম্মান করেন। মালিক আমাকে ‘মিস্টার’ বলে সম্বোধন করেন। এটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। তবে, এটা ঠিক যে যারা অনিয়মিত তারা নানাভাবে বঞ্চিত হন।

অবৈধদের বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু

বৈধ ভিসা না থাকায় গত এক বছরে মালদ্বীপ সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১০ হাজারের মতো শ্রমিককে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। পাশাপাশি তারা বাংলাদেশিদের বৈধতা দেওয়ার কাজও শুরু করেছে।

শুধু কাজের জন্যই নয়, সাধ্যের মধ্যে হওয়ায় অনেক বাংলাদেশি পরিবার নিয়ে ভ্রমণে আসেন এখানে / ছবি- ঢাকা পোস্ট 

বাংলাদেশ হাই কমিশন জানায়, ইতোমধ্যে মালদ্বীপ সরকার অবৈধ নাগরিকদের বৈধ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। বছরখানেক আগে মালে স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানে প্রায় ৩৮ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি কর্মী নিবন্ধন করেন। পরবর্তীতে অনলাইনে দুই হাজার কর্মী নিবন্ধন করেন। সবমিলিয়ে ৪০ হাজার নিবন্ধন করেছেন। তবে প্রক্রিয়া এখনও শেষ না হওয়ায় তারা বৈধতা পাননি।

এআর/