জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষা খাতে বিপ্লব আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেটে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে শুরু হওয়া উন্নয়নের ঝান্ডা এখন বয়ে নিয়ে চলেছেন তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শিক্ষা খাতে উল্লেখ করার মতো বাংলাদেশের অর্জন এখন অনেক। উল্লেখযোগ্য অর্জন নিয়েই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে বাংলাদেশ। তবে শিক্ষাবিদদের মতে, সংখ্যাগত দিক থেকে শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি হলেও মানের দিক থেকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছানো যায়নি।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা এখন বিশ্বের কাছে উদাহরণ। বছরের প্রথম দিনে দশম শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই বিতরণেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ ভর্তি, শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা এখন বিশ্বের কাছে উদাহরণ। বছরের প্রথম দিনে দশম শ্রেণি বা সমমান পর্যন্ত বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যবই বিতরণেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে নিরক্ষরতা কমেছে আশানুরূপ গতিতে। ২০০৮ সালে যেখানে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১ শতাংশ, এখন তা প্রায় ৭৫ শতাংশ। প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগ। এ স্তরে ঝরে পড়ার হারও এখন শূন্যের কোটায়। বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষা স্তরে নারী শিক্ষার্থীর হার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মাদরাসা শিক্ষাধারার আধুনিকায়ন হয়েছে। ব্যাপকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে।

উচ্চশিক্ষা ছড়িয়ে দিতে একের পর এক বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হচ্ছে। বেড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও। মেডিকেল, টেক্সটাইল, ম্যারিটাইম, এভিয়েশন সায়েন্স, ডিজিটাল ইত্যাদি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গত অর্ধশতকে শিক্ষার ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।

তবে মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, শিক্ষানীতির পুরো বাস্তবায়ন না হওয়া এবং শিক্ষা আইন তৈরিতে দেরি হওয়া দেশের শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পথে বাধা হয়ে আছে। এত সব উন্নতির মাঝেও তাই শিক্ষার মানের প্রশ্নে শিক্ষাবিদদের অতৃপ্তি যেন রয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ মস আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষা খাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সবক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেটা দরকার, প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে শিক্ষাপাঠ্যক্রম আরও যুগোপযোগী করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ মস আরেফিন সিদ্দিক / ফাইল ছবি 

তিনি বলেন, শিক্ষা সহজ-সর্বস্ব হওয়ায় আমরা সঠিক শিক্ষা দিতে পারছি না। সহজ-সর্বস্ব শিক্ষা থেকে সুশিক্ষায় রূপান্তরের জন্য শিক্ষাপাঠ্যক্রমের মাঝে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা দরকার। প্রাথমিক শিক্ষাকে বঙ্গবন্ধু একমুখী করে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করেছিলেন। আমাদের সেই জায়গায় ফিরে যাওয়ার দরকার। পাঠ্যক্রমের বিস্তৃতি বা সবগুলো মাধ্যমের (বাংলা, ইংরেজি, মাদ্রাসা) একটা সমন্বয় দরকার। একটি নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম থাকতে হবে, শিক্ষার্থীরা যে মাধ্যমেই পড়ুক না কেন, এ অংশ পড়া বাধ্যতামূলক করতে হবে।

ঢাবির সাবেক এ উপাচার্য আরও বলেন, গ্রেড পয়েন্ট দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করি, এটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলা, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য— সার্বিক বিষয়গুলো যদি পাঠ্যক্রমে নিয়ে আসা যেত তাহলে আমার মনে হয় অবকাঠামোগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মানবিক উন্নয়নও ঘটান যেত।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষা খাতে বিগত ৫০ বছরে আমাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রথম অর্জন হলো, সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিক্ষার জন্য চাহিদা তৈরি। আমাদের দেশে এটা এখন কেউ অস্বীকার করবে না যে শিক্ষার দরকার নেই। গ্রামের একজন ভূমিহীন, দিনমজুর বা কৃষককে জিজ্ঞেস করলে তিনিও বলবেন, সন্তানদের লেখাপড়া করাতে হবে। এটা পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশও করতে পারেনি।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী / ফাইল ছবি

দ্বিতীয় অর্জন হলো, ছেলে-মেয়ের সমতা। এটা হলো বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্জন। স্বল্পোন্নত দেশ হয়েও বাংলাদেশ এখন শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা অর্জন করতে পেরেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা এখন বলতে গেলে সমান।

তৃতীয় অর্জন হলো, বছরের প্রথম দিন উৎসব করে বিনামূল্যে বই বিতরণ। এছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের আরও কিছু করা বাকি আছে। কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০- এর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য 'শিক্ষা আইন' প্রণয়ন হয়নি। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নিয়ে সেটাকে জাতীয়করণ করা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার পরপরই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। এরপর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মাধ্যমিক পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ করছে। শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য কমেছে। ডিগ্রি পর্যন্ত ছাত্রীদের পড়াশোনা অবৈতনিক করা হয়েছে। সেকেন্ডারি লেভেল পর্যন্ত উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের পড়ালেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে প্রাথমিক আর মাধ্যমিকের মতো এখানেও সংখ্যার চেয়ে মানকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম অহিদুজ্জামান / ফাইল ছবি

তিনি বলেন, কিছু বিষয়ে আমাদের জোর দেওয়া দরকার। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণায় বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ ঘটাতে হবে। জ্ঞাননির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা গঠন করতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে মূল্যবোধ সংযুক্ত করতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কারিগরি ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা পিছিয়ে আছি। তবে সরকার এ খাতের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে কারিগরি শিক্ষাকে ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়ে অহিদুজ্জামান বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষা ১-১.৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। স্কুলের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষায়ও উন্নতি হয়েছে। কওমী শিক্ষাকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আনা হচ্ছে। মাদরাসায় কারিগরি শিক্ষা শাখা চালুর ব্যবস্থা হচ্ছে।

এএজে/এমএআর/