১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বাঙালির সামনে স্বাধীনতার নতুন সূর্য। এই দিন রেসকোর্স ময়দানে মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরেছিল ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- সাহসী উচ্চারণ বুকে নিয়ে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করার পরে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল। উচ্চারিত হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’- বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতিতে উড়েছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। এই দিন স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব নিয়ে পতাকার মতো উড়ছে ৫০ বছর ধরে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফিরে আসা স্বাধীনতা অর্জনের আর একমাত্রা। তিনি এসে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদরাসার মাঠে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু বড় ত্যাগের বিনিময়ে। এত রক্ত কোনো দেশ, কোনো জাতি দেয়নি, যা আজ আমার বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জালেমরা রাস্তাঘাট ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। চালের গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার সরকারি কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পুলিশ ভাইদের, বিডিআর, সামরিক বাহিনীর ছেলেদের গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার সাংবাদিকদের। ... আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক। কিন্তু বড় দুঃখ ভাই, জালেমরা কিছুই রেখে যায়নি। সমস্ত নোটগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বাস করুন, যেদিন আমি এসে সরকারি দায়িত্ব নিলাম এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও পাইনি।’

বিজয় লাভের পরে এই ছিল বাংলাদেশের পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশের বিজয় গৌরব ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বিজয়ের পঞ্চাশ বছর বাঙালির গৌরব অর্জনের দিন। বিজয় দিবস বাঙালি একটি দিনে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বিজয়ের বহুমাত্রিক মাত্রায় বাংলাদেশের নানামুখী বিজয়-অর্জন আজকের বিশ্বে দৃশ্যমান প্রেক্ষাপট।

১৯৭২ সালের ৯ মে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু বড় ত্যাগের বিনিময়ে। এত রক্ত কোনো দেশ, কোনো জাতি দেয়নি, যা আজ আমার বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে...

১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন। সেদিন তিনি বাংলা ভাষাকে পুরো বিশ্বের সামনে মর্যাদার অবস্থানে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই গৌরবময় অর্জন ছিল বাঙালির সাংস্কৃতিক বিজয়। পাশাপাশি জাতিসত্তার অস্তিত্বের প্রশ্নে এই বিজয় ছিল দিগন্ত ছোঁয়ার স্বপ্ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখনই জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদান করেছেন তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। বাংলা এখনো পর্যন্ত জাতিসংঘের সরকারি ভাষা হয়নি। সেটা সামনে রেখেই প্রধানমন্ত্রী ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। এটাই নেতৃত্বের সাহসী দৃঢ়তা। বিজয় দিবসকে একদিনে সীমাবদ্ধ না রাখার অঙ্গীকার। এভাবে আমাদের বিজয়ের অর্জন ছড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

তিনি তার ভাষণে বলেছিলেন, “বিশ্বের ২৫ কোটি মানুষের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দাবি উত্থাপন করেছি। ... আজ সারা বিশ্বের সকল নাগরিকের সত্য ও ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেরণার উৎস ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।” এভাবে বিজয়ের অর্জনের মাত্রাকে বহুমুখী করে বাংলাদেশের পথচলা হিমালয় শীর্ষের উচ্চতা লাভ করবে। পরবর্তী প্রজন্ম শিখবে দেশের মর্যাদার প্রশ্নে আপোষ করতে নেই। দেশ ও জাতিসত্তা বেঁচে থাকার মৌলিক সত্য।

জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে আজকের বাংলাদেশ মানবিক বোধের চেতনায় শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দেশ। বিজয়ের এও এক বিশাল অর্জন।

১৯৯৯ সালে বিজয়ের আর এক অর্জন ঘটেছে যেদিন ইউনেসকো কর্তৃক আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবন উৎসর্গ করে যে গৌরব অর্জন করেছিল ইউনেসকোর এই ঘোষণার মাধ্যমে সে মর্যাদার দর্শন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন।

এই বিজয় অর্জনের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি। সেদিন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে প্রবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে চিঠির মাধ্যমে বাঙালির শহীদ দিবসকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করার আবেদন করেছিলেন। জাতিসংঘ থেকে জানানো হয়েছিল বিষয়টি ইউনেসকোর এখতিয়ারভুক্ত। সেখানে পাঠাতে হবে। রফিকুল ইসলাম রীতি অনুযায়ী নানা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আবেদন পত্র সেখানে পাঠান। ইউনেসকো থেকে জানানো হয় প্রস্তাবটি বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে আসতে হবে। এরমধ্যে বেশ লম্বা সময় গড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব পাঠানোর সময় ছিল মাত্র ২ দিন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে এক সুদূরপ্রসারী বিজয় অর্জন করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘ইউনেসকোতে যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে হবে তা আপনারা দ্রুত পাঠিয়ে দিন। ফাইলের ফর্মালিটিজ পরে সম্পন্ন করবেন।’ গৌরব অর্জনে এ এক অসাধারণ সিদ্ধান্ত ছিল। ইউনেসকোর জেনারেল কনফারেন্সে প্রস্তাবটি সেই সভায় উত্থাপিত না হলে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ প্রস্তাব উত্থাপন ভবিষ্যতে আর হতো না।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ১৮৮টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে পাস হয় মাতৃভাষা দিবসের এই প্রস্তাব। বিশ্বজুড়ে গণমানুষের কাছে পৌঁছে গেছে মাতৃভাষার মর্যাদার এই বার্তা। গৌরবে মহীয়ান হয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১-এর বিজয় দিবস প্রবহমান ধারায় রক্ষা করে চলেছে বিজয়ের গৌরব। এই পর্যায়ে আরও একটি দিন অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। কানাডার বিভিন্ন প্রদেশ যেমন, ওন্টারিওর টরোন্টো সিটি, ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সারে সিটি, ভ্যাঙ্কুভার, রিচমন্ড সিটিসহ আরও অনেক শহরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সরকারিভাবে পালিত হয় ২০০৭ সাল থেকে। অস্ট্রেলিয়ার ফেডারেল পার্লামেন্টে দিবসটি সরকারিভাবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাংলাদেশ মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবনদানকারী দেশ। পৃথিবীজুড়ে বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা। সব দেশের সামনে এখন আশার আলো নিয়ে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ গৌরবময় বিজয় অর্জনের আর একটি অন্যতম মাত্রা। বিশ্বের অগণিত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে উচ্চারিত হবে এই ভাষণের পঙ্‌ক্তিসমূহ। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে প্যারিসের ইউনেসকো সদর দপ্তরে মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা ঘোষণা দিলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ‘বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’-এ। ইউনেসকো জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা।

ইউনেসকোর এই স্বীকৃতি ইতিহাসের বড় সময় ধরে বিশ্বজুড়ে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ তৈরি করেছে। ইউনেসকোর মাধ্যমে বাঙালির অর্জন বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য। যে ঐতিহ্য মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। অনুপ্রেরণা প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে মানুষের মানবিক অধিকারকে সুরক্ষিত করে। বলতেই হবে বাঙালির বিজয় দিবসের বহুমাত্রা নিয়ে ৭ মার্চের এই ভাষণ বিজয়ের গৌরবগাথা।

জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘যে মহান আদর্শ জাতিসংঘের সনদে রক্ষিত আছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে। শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তোলার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ 

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শুরু করেছিলেন, ভাইয়েরা আমার’ সম্বোধন করে। ইউনেসকো কর্তৃক স্বীকৃত ভাষণ বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ স্বর ধ্বনিত হবে বিশ্বজুড়ে। তিনি বিশ্ববাসীকে জড়ো করে বলছেন, ‘ভাইয়েরা আমার’। ইউনেসকোর মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড কর্মসূচির অ্যাডভাইজরি কমিটির ১৫ জন সদস্য দুই বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক দলিলসমূহ গভীর পর্যবেক্ষণের আওতায় এনে যে সিদ্ধান্ত দিল তাতে বাঙালির দরজা খুলে গেছে বিশ্ববাসীর সামনে। যেভাবে বিশ্বের মানুষ আব্রাহাম লিঙ্কনের ভাষণ স্মরণ করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চেতনায় Government of the people, by the people, for the people. মানুষের প্রতিরোধের জায়গা জোরদার হয়ে ওঠে নেতৃত্বের অমর বাণী থেকে। বাংলাদেশও এই জায়গাটি তৈরি করেছে।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ Jacob F. Field একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন We shall Fight on The Beaches The Speeches That Inspired History শিরোনামে। গ্রন্থটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে। এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে The Struggle This Time is the Struggle for Independence শিরোনামে। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থটি বিশ্বের অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছেছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ভারতের পশ্চিম বাংলায় এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সব মিলিয়ে ১৬২টি ছিটমহল সৃষ্টি হয়েছিল। এসবের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের অংশে ছিল ভারতের ১১১টি ছিটমহল। আর ভারতের অংশে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ৫১টি ছিটমহল। একরকম বন্দিজীবন কাটিয়েছে ছিটমহলের অধিবাসীরা। অন্য রাষ্ট্র দ্বারা সীমান্ত রক্ষিত ছিল বলে তাদের ছিটমহলের বাইরে যাওয়ার অনায়াস ব্যবস্থা ছিল না। তারা বঞ্চনার জীবনযাপন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত জীবন ছিল তাদের। ভোটাধিকারও ছিল না ছিটমহল বাসীর। তারা অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার দীর্ঘ বছর অতিবাহিত করে।

যেদিন ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দিল্লিতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দীর্ঘ বছর গড়িয়েছে। ’৪৭ পরবর্তী সময় থেকে ৬৮ বছর পার হয়েছে। কিন্তু ছিটমহল বাসীর জীবনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক জীবনের মুক্তির সন্ধান মেলেনি। চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে এই চুক্তির বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গণমানুষের পক্ষে মানবিক চেতনার দীপ্ত নেত্রী। মানুষের বেঁচে থাকার সহজ সত্যকে তিনি মূল্যায়ন করেন। সমাধানের পথে এগিয়ে আসেন। তারই ফলশ্রুতি দেশভাগের ৬৮ বছর পরে ছিটমহলের মানুষের বন্দি জীবনের অবসান ঘটে। এটা ছিল মানবিকতার পক্ষে বড় ধরনের বিজয়-অর্জন।

বাংলাদেশের সমুদ্র জয় এমন আরও একটি বড় অর্জন। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ বাংলাদেশ মিয়ানমারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্র সীমার যে বিরোধ ছিল তা ‘সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে’ [International Tribunal for the Law of the Sea (ITLOS)] নিষ্পত্তি হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, এটি একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। বিশ্বের মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মতো দীপ্ত গৌরবের উদাহরণ থাকবে। এমন আরও অর্জন আছে বাংলাদেশের ৪৬ বছরের ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।

জয় হোক বিজয়ের গৌরবের। জয় হোক দেশবাসীর। বাংলাদেশের মানচিত্রে উড়তে থাকবে লাল-সবুজ পতাকা। এই পতাকা বিভিন্ন দেশে ওড়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেট দল—ওড়ায় বাংলাদেশের ফুটবল-ক্রিকেট খেলোয়াড় মেয়েরা। এই দীপ্ত আলোর দিকে তাকিয়ে এ বছরে উদযাপিত হোক বিজয় দিবস। আমাদের তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে আসুক বিজয়ের মুকুট মাথায় নিয়ে।

সেলিনা হোসেন ।। কথাসাহিত্যিক