মধুমতি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সফিউল আজম। ২০১৬ সালের ৮ আগস্ট থেকে ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৯১ সালে তিনি এবি ব্যাংকের প্রবেশনারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) এবং মধুমতি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যাংক খাতের সার্বিক অবস্থা, চিহ্নিত প্রতিবন্ধকতা, সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেন মো. সফিউল আজম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম

ঢাকা পোস্ট : করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক খাত। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে যদি বলতেন…

সফিউল আজম : শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওষুধ, আইটিসহ কয়েকটি খাত ছাড়া মহামারি করোনায় সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। ব্যাংকের ব্যবসা কমেছে, আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক সহযোগিতায় আমরা ব্যবসায়ীদের পাশে থেকে বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছি। ফলে আমাদের গ্রাহকরা করোনার ক্ষতি অনেকাংশে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। 

সরকার কারোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সরকারের এমন উদ্যোগের প্রশংসা না করলেই নয়। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে আমি ধন্যবাদ জানাই। উনি যদি সময়োপযোগী এ পদক্ষেপ না নিতেন তাহলে আমরা অনেক বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতাম।

গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে গিয়েছিল। এখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি বেড়েছে। প্রচুর রফতানির আদেশ আসছে। সামনের দিনগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্যের আরও প্রসার ঘটবে, ঋণের চাহিদাও বাড়বে বলে বিশ্বাস করি।

ঢাকা পোস্ট : ব্যাংকিং সেবার প্রসারে নতুন বছরে মধুমতি ব্যাংকের বিশেষ কোনো উদ্যোগ আছে কি না?

সফিউল আজম : মহামারির আগে ও পরে মধুমতি ব্যাংক গ্রাহকদের উন্নত সেবা দিতে কাজ করছে। ইতোমধ্যে আমরা বেশকিছু নতুন উদ্যোগ নিয়ে ২০২২ সালের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। সেখানে বেশকিছু খাত চিহ্নিত করে কাজ করছি। এর মধ্যে আমাদের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে গ্রাহকদের কাউন্সিলিং করছি। 

মধুমতি ব্যাংক শুরু থেকেই গ্রাহকদের সহযোগিতায় কাজ করছে। করোনার সময় সরকারের বিশেষ প্যাকেজ বাস্তবায়নে আমরা সফল হয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্যাকেজের শতভাগ ঋণ বিতরণ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে পুরস্কারও পেয়েছি আমরা।

ঢাকা পোস্ট : মধুমতি ব্যাংক কোন খাতকে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে?

সফিউল আজম : নতুন বছর উপলক্ষে আমরা যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি সেখানে বেশ কয়েকটি অগ্রাধিকার মূলক খাত চিহ্নিত করেছি। এখন দেশে প্রচুর উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে। তাই আমরা আগামীতে ঠিকাদারি ব্যবসাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত, আমরা তৈরি পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ (পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প) পণ্যগুলোর ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। 

রফতানি পণ্য ও বাজার বহুমুখী করতে নন-ট্রেডিশনাল আইটেমগুলোর ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেমন- পাট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রসারে বেশি ফোকাস দিচ্ছি। এছাড়া ওষুধ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছি। বিশেষ করে ওষুধের কাঁচামাল এখনও আমদানিনির্ভর। এটা যেন দেশেই উৎপাদন হয়, এজন্য এ খাতে আমরা বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : নতুন প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংকের নতুনত্ব কী? কেন গ্রাহক আপনাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আগ্রহ দেখাবেন?

সফিউল আজম : মধুমতি ব্যাংক শুরু থেকেই নতুনত্বে বিশ্বাসী। আমাদের বেশ কয়েকটি ইউনিক প্রডাক্ট রয়েছে যা অন্য কোনো ব্যাংকে নেই। যেমন- মধুমতি একমাত্র ব্যাংক যারা গোল্ড ডিলারশিপ নিয়েছে। আমরা এ (গোল্ড) ডিলারশিপের আওতায় নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের এলসি (ঋণপত্র) খোলার সুযোগ করে দিচ্ছি। এছাড়া আগামীতে আমরা আইটি পণ্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। 

আমাদের স্মার্ট অ্যাপ আছে, সেখানে গ্রাহকরা প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারছেন। দৈনিক সব ধরনের ব্যাংকিং লেনদেন যেমন- ট্যাক্স চালান থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল, ই-চালান, কেনাকাটাসহ সব ধরনের ব্যাংকিং লেনদেন যেন স্বল্প খরচে করা যায় আমরা সেই বিষয়ে জোর দিচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ঋণ বিতরণ আমানত সংগ্রহে কোন ধরনের কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন?

সফিউল আজম : প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা গ্রাহকসেবাকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। অর্থাৎ আমরা যদি গ্রাহককে কম খরচে ভালো সেবা দিতে পারি তাহলে তারা আমাদের এখানে আসবেন। অগ্রাধিকার খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েই আমরা ঋণ বিতরণ করছি।

গ্রাহক আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে আমরা খরচ কমানোর ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য খরচ কমিয়ে ডিপোজিট রেটটা বাড়িয়ে দেওয়া। কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে। এর মধ্যে থেকে আমরা যদি গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে চাই তাহলে খরচ কমানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা বিষয়টির ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্ট অ্যাকাউন্টগুলো আনার চেষ্টা করছি। সেলারি অ্যাকাউন্ট ও কালেকশন অ্যাকাউন্ট যেমন বিভিন্ন ইউটিলিটি ও প্রকল্পের বিল কালেকশনের ওপর জোর দিচ্ছে। এভাবে ডিপোজিট বাড়িয়ে আমরা আমানত সংগ্রহের কাজ করছি।

ঢাকা পোস্ট : ২০১৮ সালে গ্রামীণ অঞ্চলের ক্ষুদ্র মধ্যম উদ্যোগের ব্যাংক হওয়ার পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বাস্তবায়ন কত দূর?

সফিউল আজম : গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করতেই আমরা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলাম। ইতোমধ্যে ৫০০-এর বেশি এজেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করেছি, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা নিতে পারছেন। এখন পর্যন্ত আমরা এজেন্ট পয়েন্ট আমানত সংগ্রহের ওপর বেশি জোর দিয়েছি। পাশাপাশি এখানে আমরা কিছু লাইফ স্টাইল প্রোডাক্টও যুক্ত করেছি। এর মধ্যে রয়েছে টেলিমেডিসিন সেবা, মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স ফ্যাসিলিটি। এছাড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যারা সামাজিক সুরক্ষা ভাতা পান, বেশকিছু জেলায় আমরা সেগুলো বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছি।

সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপি’র একটি প্রকল্প আমরা হাতে নিয়েছি। এনজিও’র মাধ্যমে এটির কাজ চলছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দক্ষ উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টা চলছে।

ঢাকা পোস্ট : নতুন বেশকিছু ব্যাংকের বিষয়ে জনমনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা ছিল বা রয়েছে। ব্যাংকিং সেবা প্রসারের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রভাব লক্ষ্য করেছেন কি না?

সফিউল আজম : চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর বিষয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, এটা সত্য। তবে আমাদের ব্যাংকটি শুরু থেকেই অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদ দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। পর্ষদের প্রতিটি সদস্য ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী হিসেবে আমাদের সহযোগিতা করছেন। তাদের যোগ্য ও গতিশীল নেতৃত্বে ব্যাংকটি ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করে। গত আট বছরে ব্যাংকটি প্রত্যেকটি আর্থিক সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। আমানত-ঋণ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স সংগ্রহ— সবক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো।

আমাদের সর্বশেষ (২০২০ সাল) আর্থিক প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেন, প্রতিটি সূচকেই আমরা ভালো অবস্থানে আছি। 

ঢাকা পোস্ট : করপোরেট সুশাসন চর্চায় আপনাদের ভূমিকা কেমন?

সফিউল আজম : ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে করপোরেট সুশাসন চর্চার বিকল্প নেই। আমরা শুরু থেকেই এটি পরিপালন করে আসছি। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সার্বিক কর্মকাণ্ডে এখানকার পরিচালনা পর্ষদ কোনো হস্তক্ষেপ করে না। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি অনুসরণ করে ব্যাংকটি পরিচালনা করছেন। নিয়মমাফিক পরিচালিত হওয়ায় ২০২০ সালের সবগুলো সূচকে ব্যাংকটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে। 

ঢাকা পোস্ট : খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আপনাদের বিশেষ কোনো উদ্যোগ আছে কি না?

সফিউল আজম : ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই সতর্ক থাকি। এ কারণে আমাদের খেলাপির পরিমাণ কম। ২০২০ সালের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের খেলাপি ঋণের রেশিও ১ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থাৎ এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়া এ খাতের সার্বিক খেলাপি রেশিওর অনেক নিচে অবস্থান করছে মধুমতি ব্যাংক।

ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রাথমিক কাজ হলো- আমরা কাকে ঋণ দিচ্ছি, সেটি যথাযথভাবে যাচাই করা। আমরা যে গ্রাহককে ঋণ দিই তার পূর্বের আচরণ, ব্যবসার অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যতে কাজ করার সম্ভাবনা, যে কাজের জন্য ঋণ নিচ্ছেন সেটি তিনি কতটুকু বোঝেন, তার জামানত ক্যাশ ফ্লো’র কী অবস্থা— এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে আমরা ঋণ দিচ্ছি। এ কারণে আমাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম। তারপরও খেলাপি হলে এবং সেটি আদায়ে আইনের মাধ্যমে আমরা বিশেষ নজর দিচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : শেয়ারবাজারে আসার কোনো চিন্তাভাবনা আপনাদের আছে কি না?

সফিউল আজম : শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য আমাদের পরিচালনা পর্ষদ ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছে। আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এখন সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা করে বোর্ডে প্রতিবেদন জমা দেব। আশা করছি আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা শেয়ারবাজারে আসব।

এসআই/এমএআর/