২০২১ সাল ‘বিষাদময়’ হলেও প্রাপ্তির মধ্যে আছে মাঠের কর্মসূচিতে ফেরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে আনা-নেওয়া এবং তার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির জন্য সরকারের কাছে দাবি ও আহ্বান জানিয়ে ২০২১ সাল পার করেছে বিএনপি। দলীয় প্রধানের অসুস্থতায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে বছরের বিভিন্ন সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ‘এককভাবে’ নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন দলটির নেতারা। সবকিছু মিলিয়ে গেল বছর ‘বিষাদময়’ হলেও প্রাপ্তির মধ্যে ‘মাঠের কর্মসূচিতে ফেরা’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তে ‘ক্ষমতাসীন দলকে চাপের মধ্যে ফেলা’র বিষয়টি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। পাশাপাশি নতুন বছরে নতুন উদ্যমে রাজনীতি করতে ‘ছাড় দেওয়ার’ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে দলটি।

করোনা মহামারির কারণে সারাবিশ্বের মতো ২০২১ সালের শুরু থেকে বিএনপির রাজনীতি ছিল ঘরবন্দি। মার্চে দেশে করোনা প্রভাব কিছুটা কমলে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করে দলটি। এর মধ্যে মার্চ বিএনপির জন্য বড় দুঃসংবাদ নিয়ে আসে। ১৬ মার্চ বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এর মধ্যে দেশে আবারও করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। গত ১ এপ্রিল থেকে ফের সব ধরনের মাঠের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়, ভার্চুয়াল কর্মসূচিতে ফিরে যায় সব দল।

২০২১ সাল ‘বিষাদময়’ হলেও প্রাপ্তির মধ্যে ‘মাঠের কর্মসূচিতে ফেরা’ এবং আন্তর্জাতিকভাবে নেওয়া কিছু সিদ্ধান্তে ‘ক্ষমতাসীন দলকে চাপের মধ্যে ফেলা’র বিষয়টি বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। পাশাপাশি নতুন বছরে নতুন উদ্যমে রাজনীতি করতে ‘ছাড় দেওয়ার’ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে দলটি

ঘরবন্দি থাকা অবস্থায় আবারও বিএনপির জন্য দুঃসংবাদ আসে। ১১ এপ্রিল চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার করোনায় আক্রান্তের খবর আসে। চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিনযাপন শুরু হয় দলটির নেতাকর্মীদের। এ সময় টানা ৫৪ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর বাসায় ফিরলেও নিয়মিত বিরতিতে তাকে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকতে হয়। 

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির জন্য সরকারের কাছে ধরনা দেওয়া, দাবি ও বিভিন্নভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছেন বিএনপির নেতারা। গত ১৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দলটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘খালেদা জিয়া জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন। তিনি লিভার সিরোসিসসহ অন্যান্য জটিলতায় ভুগছেন। দেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়। অবিলম্বে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন।’ তারা আরও বলছেন, কবে তিনি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে পারবেন তাও বলা যাচ্ছে না। যেকোনো মুহূর্তে  বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যে আছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, সরকারের সবাইকে হত্যার আসামি করা হবে।’

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া / ফাইল ছবি

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত ১২ বছর যেভাবে গেছে, আমরা সেভাবেই ২০২১ সাল পার করেছি। বরং গেল বছর নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) জেলে নেওয়া, ম্যাডামের অসুস্থতা। জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়েছে। সবমিলিয়ে ২০২১ সাল মানুষের জন্য ভালো যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভালো থাকা নির্ভর করে দেশের মানুষের ভালো থাকার ওপর। আজ বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা সাংঘাতিক কষ্টে আছে।’

টুকু বলেন, ‘ম্যাডামের অসুস্থতা আমাদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। ২০০৮ সাল থেকেই আমরা ভালো নেই। দেশের মানুষ ভালো নেই।’

দলটির অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘২০২১ সাল শুধু আমাদের জন্য নয়, সারা বিশ্ববাসীর জন্য খারাপ গেছে। তবে, জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য বছরটি ছিল অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কারণ, জাতীয়তাবাদী শক্তির ঐক্যের প্রতীক খালেদা জিয়া। বছরের বেশির ভাগ সময় তিনি অসুস্থতার মধ্যে কাটিয়েছেন। এখনও তিনি হাসপাতালে। ফলে, আমাদের জন্য ২০২১ সাল ভালো যায়নি।’

নতুন বছরে নতুন উদ্যমে রাজনীতি করতে ‘ছাড় দেওয়ার’ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি/ ছবি- সংগৃহীত

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, গেল বছরজুড়ে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করেছেন। কষ্টকর জীবন-যাপন করেছেন। এখনও করছেন। তার জন্য আমাদের যেটা করার কথা ছিল, সেটা আমরা করতে পারিনি। তার জন্য করা মানে গণতন্ত্রের জন্য করা। গণতন্ত্রের যে প্রতিবন্ধকতা সেটা আমরা দূর করতে পারিনি।

‘তবে, আশার দিক দিক হচ্ছে লড়াই করার প্রবণতা। সেটা ২০২১ সালে মানুষ খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে যে লড়াই করতে হয়, দেশের মানুষ সেটা ভালো করে শিখেছে এবং করিয়ে দেখিয়েছে’— বলেন বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান।

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, করোনার কারণে বছরের প্রথম দিকে দলটির রাজনীতি ঘরবন্দি থাকলেও শেষের দিকে এসে সারাদেশে বেশকিছু সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার দাবিতে এসব সভা-সমাবেশে মানুষেরও ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। করোনার মধ্যেও একবারে থেমে ছিল না দলীয় কর্মকাণ্ড। নিয়মিত ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক। ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটিসহ অনেক জেলায় দলের নতুন নতুন কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

এদিকে কেউ কেউ বলছেন, গেল বছরে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি সেভাবে উত্তাপ ছড়াতে না পারলেও দলের ভেতরে একটা আতঙ্কভাব বিরাজ করেছে। প্রবাসে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেওয়া কয়েকটি সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে দলের মধ্যে আতঙ্ক ও অস্থিরতা ছড়িয়েছে। বছরের শেষদিকে এসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে দলের খুলনা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর আগে এপ্রিল মাসে দলের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আব্বাসের কাছে গুম হওয়া ইলিয়াস আলীকে নিয়ে তার দেওয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। বিষয়টি অনেকে ভালোভাবে দেখেননি। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময় দল থেকে পদত্যাগ করেন অনেক নেতা। এসব ঘটনাও বিএনপির মধ্যে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করে।

বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর / ফাইল ছবি 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, গেল বছর আমরা ভাবতে-ভাবতেই পার করে দিয়েছি। কী করার উচিত, কী করা উচিত নয়— এটা ভাবতে-ভাবতে সময় চলে গেছে আমাদের। তারপরও বছরশেষে আমরা কিছুটা হলেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ফিরতে পেরেছি। এটাই আমাদের একমাত্র আশার দিক।

গেল বছরে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি সেভাবে উত্তাপ ছড়াতে না পারলেও দলের ভেতরে একটা আতঙ্কভাব বিরাজ করেছে। প্রবাসে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেওয়া কয়েকটি সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে দলের মধ্যে আতঙ্ক ও অস্থিরতা ছড়িয়েছে

তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালে বিএনপির জন্য সুখকর তেমন কোনো স্মৃতি নেই। বরং ম্যাডামের অসুস্থতার পাশাপাশি দলের হাইকমান্ডের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত দলের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে। এর মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও খুলনার সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। দুজনেরই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অতীত আছে। তাদের বিষয়ে হাইকমান্ডের নেওয়া সিদ্ধান্তে দলের নেতারা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখালেও একটা প্রশ্ন কিন্তু তৈরি হয়েছে। যেটা দলের জন্য মোটেও ভালো নয়।

এছাড়া গেল বছর বিএনপির জন্য অস্বস্তিকর হয়ে থাকবে ২০ দলীয় জোট থেকে শরিকদের পদত্যাগ। শরিকদের প্রতি বিএনপির অবহেলার অভিযোগ এনে ২০২১ সালে জোট ছাড়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি ছিল, সরকারের চাপে পড়ে তারা জোট ছেড়েছে।

২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে যাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনও চালিয়ে যাওয়া। এজন্য দলকে আরও সুসংগঠিত করা। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এক জায়গায় নিয়ে আসা

তবে বছরের শেষদিকে এসে মাঠের রাজনীতিতে ফেরার যে ধারা, সেটা অত্যন্ত স্বস্তিদায়ক ছিল দেশের অন্যতম প্রধান এই রাজনৈতিক দলের জন্য। মাঠের রাজনীতিতে ফেরার এই ধারা অব্যাহত রেখে নতুন বছরে নতুন উদ্যমে রাজনীতি করতে চায় বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়ে যাবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ। কিন্তু আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি দলীয়প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনও চালিয়ে যাওয়া। এজন্য দলকে আরও সুসংগঠিত করা। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এক জায়গায় নিয়ে আসা।

২০২১ সালের শেষের দিকে এসে মাঠের কর্মসূচিতে ফেরাকে স্বস্তিদায়ক বলছেন বিএনপির সংশ্লিষ্টরা / ছবি- সংগৃহীত 

বিএনপির নেতারা বলছেন, দেশের সব রাজনৈতিক দলকে একটি প্ল্যাটফর্মে আনতে বিএনপিকে যদি কোনো ছাড় দিতে হয়, তার জন্যও মানসিকভাবে প্রস্তুত আছেন তারা।

নতুন বছরের চাওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিগত বছরের সব ব্যর্থতা, গ্লানি মুছে বাংলাদেশকে একটা সম্মানের স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা। সেটা করতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চেতনা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য দরকার সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা। যা সরকার সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই এখন মুখ্য। নির্বাচনের প্রস্তুতি এখানে গৌণ। এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে কোনোদিন নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। তাই বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা— এটাই আমাদের লক্ষ্য। এজন্য আমাদের দলকে আরও সুসংগঠিত করার কাজ চলছে।

২০২১ সালে করোনায় বিএনপির চার শতাধিক নেতাকর্মী মারা গেছেন বলেও জানান দলটির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান।

এএইচআর/এমএআর/