ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের যথাযথ চিকিৎসার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৫ সালে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে যাত্রা শুরু হয় বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতালের। এই রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের স্বপ্ন ছিল স্বল্প খরচে গরিব ও অসহায় মানুষকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া। সেই লক্ষ্যে সৈয়দপুরের পর রাজধানীর কাছে সাভারে আরও একটি বিশেষায়িত ফাইলেরিয়া হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেন তিনি।

বাংলাদেশ সরকার ও বেসরকারি সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এলার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমুনোলজি অব বাংলাদেশের (আইএসিআইবি) অর্থায়নে নেওয়া এমন একটি মহৎ উদ্যোগ আজ মহাদুর্নীতির শিকার।

সাভারের জিনজিরায় ৬৭ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ কাজ করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাকাব ট্রেড করপোরেশনের মালিক হাবিবুর রহমান চম্পট দিয়েছেন। অদৃশ্য ক্ষমতার বলে প্রকল্পের পুরো টাকাই হাতিয়ে নেন হাবিবুর গং

সাভারের জিনজিরায় ৬৭ শতাংশ জমির ওপর প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ কাজ করেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাকাব ট্রেড করপোরেশনের মালিক হাবিবুর রহমান চম্পট দিয়েছেন। অদৃশ্য ক্ষমতার বলে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পের পুরো টাকা।

যতটুকু কাজ হয়েছে সেখানেও রয়েছে গলদ। অত্যন্ত নিম্নমানের কাজ হওয়ায় বিভিন্ন দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। সেনেটারি, ইলেকট্রিক্যাল ও আসবাবপত্রের কাজও হয়েছে নিম্নমানের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকেই শুরু হয় অনিয়ম। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাকাব ট্রেড করপোরেশন মাত্র ৩০০ টাকার পে-অর্ডার ৩০ লাখ টাকা দেখিয়ে সিকিউরিটিজ হিসেবে জমা দেন। প্রতিষ্ঠানটির অভিজ্ঞতা সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্সও ছিল জাল।

২০১২ সালে মূল হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও ব্যবহারিক সরঞ্জাম সরবরাহেও ছিল ভয়াবহ জালিয়াতি। অসমাপ্ত কাজ শেষ করার আর্জি ও দুর্নীতির বিচারের দাবিতে সমাজসেবা অধিদফতর কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও হতাশ হয়েছেন আইএসিআইবি চেয়ারম্যান ও ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন। উল্টো নিজেই এখন মামলার আসামি

২০১২ সালে মূল হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও আজও তা হয়নি। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও ব্যবহারিক সরঞ্জাম সরবরাহেও ছিল ভয়াবহ জালিয়াতি। অসমাপ্ত কাজ শেষ করার আর্জি ও দুর্নীতির বিচারের দাবিতে সমাজসেবা অধিদফতর কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরেও হতাশ হয়েছেন আইএসিআইবি চেয়ারম্যান ও ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন। উল্টো নিজেই এখন মামলার আসামি!

ঠিকাদার হাবিবুর রহমান এবং আইএসিআইবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও হাবিবের স্ত্রী নাছিমা আক্তার মিলেমিশে এমন জালিয়াতির স্বর্গ গড়েন। দুদকের অনুসন্ধানে এরই মধ্যে জালিয়াতির প্রমাণ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যদিও এর আগে সমাজসেবা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনেও জালিয়াতির সত্যতা মেলে। তবে চিঠি চালাচালি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি

অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার হাবিবুর রহমান এবং আইএসিআইবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও হাবিবের স্ত্রী নাছিমা আক্তার মিলেমিশে এমন জালিয়াতির স্বর্গ গড়েন। দুদকের অনুসন্ধানে এরই মধ্যে জালিয়াতির প্রমাণ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যদিও এর আগে সমাজসেবা অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনেও জালিয়াতির সত্যতা মেলে। তবে চিঠি চালাচালি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ ব্যাংক ও আর্থিকপ্রতিষ্ঠানসহ অর্ধশত প্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে সংশ্লিষ্ট বেশকিছু নথি সংগ্রহ করেছেন। চলছে টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজসেবা অধিদফতর ও আইএসিআইবি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলবের প্রস্তুতি।

এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ পর্যায়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঠিকাদার মাত্র ৩০০ টাকার পে-অর্ডার ৩০ লাখ টাকার সিকিউরিটিজ হিসাবে দেখিয়েছেন। এছাড়া কাজ পেতে যতগুলো অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দেখানো হয় তার সবই জাল। এমনকি ট্রেড লাইসেন্সও ভুয়া বা জাল হিসেবে প্রমাণ মিলেছে।

ঠিকাদার হাবিব ও তার স্ত্রী আইএসিআইবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান মিলেমিশে এ কাজগুলো করেছেন। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কিংবা ফার্নিচার সরবরাহের কাজ পেতে আত্মীয়-স্বজনদের নামও ব্যবহার করেছেন তারা (স্বামী-স্ত্রী)। কীভাবে এমন জালিয়াত চক্র কাজ পায় এবং অর্ধেক কাজ করে পুরো টাকা হাতিয়ে নেয়— সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আমরা অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করব— বলেন ওই দুদক কর্মকর্তা।

অন্যদিকে টিআইবি নির্বাহী পরিচালক মো. ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগ হরহামেশা দেখা যায়। কিন্তু হাসপাতালের নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখে ঠিকাদার চলে যাওয়ার ঘটনা ঠিকই দুঃখজনক। অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জবাবদিহির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

সরেজমিনে যা দেখা যায়

ঢাকা জেলার সাভারে ৫০ শয্যার ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি ২০১০-১২ অর্থবছরে আইএসিআইবি’র ৬৭.৭০ শতাংশ জমির ওপর অসম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক নিবন্ধিত অলাভজনক, বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আইএসিআইবি’র যৌথ অর্থায়নে নির্মিত।

কাগজে-কলমে হাসপাতালটির নির্মাণকাজ পাঁচতলা সম্পন্ন হলেও বাস্তবে পাওয়া যায় চারতলা। হাসপাতালের চারপাশে বাউন্ডারি দেয়াল থাকার কথা থাকলেও তা পাওয়া যায়নি। প্রধান গেটসহ সামনের অংশে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য পাকা করার কথা, কিন্তু করা হয়নি। বরং নির্মাণকালীন শ্রমিকদের জন্য নির্মিত কাঁচাঘর এখনও রয়ে গেছে। সামনের অংশে দেয়ালের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও তা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজ খরচে নির্মাণ করেছে বলে জানা যায়।

ঢাকা পোস্টের সরেজমিন অনুসন্ধানে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ফাইলেরিয়া ওয়ার্ড ও নার্স রুমের বিভিন্ন অংশে ফাটলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চতুর্থ তলায়ও ফাটল দেখা যায়। ছাদও অরক্ষিত। রডগুলো যেন কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুমের ফিটিংসগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। দুটি লিফট দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে রয়েছে একটি। তাও পরিকল্পনা অনুযায়ী লাগানো হয়নি

ঢাকা পোস্টের সরেজমিন অনুসন্ধানে হাসপাতালের তৃতীয় তলার ফাইলেরিয়া ওয়ার্ড ও নার্স রুমের বিভিন্ন অংশে ফাটলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। চতুর্থ তলায়ও ফাটল দেখা যায়। ছাদও অরক্ষিত। রডগুলো যেন কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাথরুমের ফিটিংসগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের। দুটি লিফট দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে রয়েছে একটি। তাও পরিকল্পনা অনুযায়ী লাগানো হয়নি।

ফাইলেরিয়া হাসপাতালের নার্স ও কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবসময় তারা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। বাইরে থেকে কোনো অতিথি এলে ভয়ে কথা বলেন না। রোগীর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ, ঠিকাদার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তারা হুমকি পাচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের স্যারের বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন হাবিবুর। আমরা তো ছোট কর্মচারী। মোয়াজ্জেম স্যার অনেক লড়াই করে হাসপাতালটি নির্মাণ করিয়েছেন। আজ তিনিই (স্যার) বিপদে রয়েছেন।

হাসপাতাল নির্মাণকাজে কেন এমন অনিয়ম

আইএসিআইবি চেয়ারম্যান ও ফাইলেরিয়া হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালটির ১০তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে পাঁচতলা করার কথা ছিল। চারতলা করা হয়েছে, তাও টেন্ডারের শিডিউল অনুযায়ী করা হয়নি। কাজের মান অত্যন্ত খারাপ। তাদের (হাবিব দম্পতি) প্রতিষ্ঠানগুলো সেনেটারি, ইলেকট্রিক্যাল ও আসবাবপত্রের কাজও করেছে। সেগুলোও নিম্নমানের।

তিনি বলেন, আমাদের বিবেচনায় প্রকল্প হিসেবে ৩৫ শতাংশের মতো কাজ করে পুরো বিল তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সাল থেকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দুদকে অভিযোগ করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। কাজ না করার ষড়যন্ত্রে উল্টো আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। ‘এনজিওর কাছে টাকা পাবে’— এমন অভিযোগে আমাকে আসামি করা হয়েছে।

ফাইলেরিয়া নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পিজিতে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কর্মরত ছিলাম। তখন থেকেই রাজধানীর রাস্তায় হাজার হাজার ফাইলেরিয়া রোগী দেখতাম। ওই সময় বলা হতো, এই রোগের চিকিৎসা নেই বা এটা নিয়ে কোনো চিকিৎসক কাজ করেন না। অসহায় রোগীদের কথা চিন্তা করে ফাইলেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করি।

আমার গবেষণাপত্র ১৯৯৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫০তম সভায় ২৯ নম্বর এজেন্ডা হিসেবে পাস হয়। আমি প্রমাণ করতে সক্ষম হই যে ফাইলেরিয়া নির্মূলযোগ্য। আগে ধারণা ছিল এই রোগের চিকিৎসা নাই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পাস হওয়ার পর আমি প্রথম জাপান সরকারের অর্থায়নে সৈয়দপুরে বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া রোগীদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ করি। কারণ, এই রোগ উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ছিল। এরপর আমি সার্ভে করে দেখলাম মশাবাহিত এই রোগ বাংলাদেশের ৫৬ জেলায় রয়েছে। তাই বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থানে অর্থাৎ রাজধানী ঢাকার আশেপাশে একটি হাসপাতালের প্রয়োজন। যেখানে এসে সারাদেশের মানুষ সেবা নিতে পারবেন। সেই চিন্তা থেকে সাভারে ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ।

ডা. মোয়াজ্জেম বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিই। যা সরকার অনুমোদন করে। ২০১১ সালে সরকার ৮০ শতাংশ ও আইএসিআইবি’র ২০ শতাংশ অর্থায়নে নির্মাণকাজ শুরু হয়। এর টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন আইএসিআইবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যান ও ঠিকাদার হাবিবুর রহমানের স্ত্রী নাছিমা আক্তার। তিনি তার স্বামী, ছেলে ও আত্মীয়-স্বজনকে কাজ দেন। ২০১২ সালে কাজ শেষ না করে উল্টো সব ধরনের বিল তুলে তারা সরে পড়েন।

হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে যা আছে

‘এস্টাবলিশমেন্ট অব এ ৫০ বেডেড ফাইলেরিয়া হাসপাতাল উইথ অ্যানসিল্যারি ফ্যাসিলিটিজ’ শীর্ষক প্রকল্পটি তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী ২০১১ সালের ১৬ মার্চ অনুমোদন দেন। প্রকল্পটির অনুমোদিত ব্যয় ১২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয়ের ৮০ শতাংশ সরকার ও ২০ শতাংশ এনজিও আইএসিআইবি বহন করে। যেখানে সরকার ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ও আইসিএসিআইবি দুই কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় করে।

২০১১ সালের জুন থেকে ২০১২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। প্রকল্পের মধ্যে ১০তলা ফাউন্ডেশনসহ মোট ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ২৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি ৭২ লাখ ৬০ হাজার, আসবাবপত্র ২৯ লাখ ৮০ হাজার, ভূমিক্রয় ৬০ লাখ ৩০ হাজার ও ব্যবহারিক সরঞ্জামাদিসহ বিবিধ ব্যয় ৩৫ লাখ ৪২ হাজারসহ ১২ কোটি ৯৪ লাখ এক হাজার টাকা।

কী বলছে সমাজকল্যাণ অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদন

অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর সাভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলীজ্জামান ২০২০ সালের ৪ মার্চ প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে অভিযোগের সত্যতা পান। ওই বছরের ৮ মার্চ অভিযোগে উল্লেখিত ত্রুটির সত্যতা পেয়ে সব অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা এবং ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন তিনি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধি অনুযায়ী পুরো প্রকল্পের (ভবন নির্মাণ ও হাসপাতালের মালামাল ইত্যাদি) জন্য একজন সরকারি প্রকল্প পরিচালক এবং এ সংক্রান্ত টেন্ডার হওয়ার কথা। সরকারি প্রকল্প পরিচালক ভবন নির্মাণের টেন্ডার কমিটির সভাপতি এবং ঠিকাদার হাবিবুর রহমানের স্ত্রী ও আইএসিআইবি’র তৎকালীন চেয়ারপারসন নাছিমা আক্তার হাসপাতালের অন্যান্য মালামাল ক্রয়ের টেন্ডার কমিটির সভাপতি। টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী মোট সাতটি টেন্ডার ডকুমেন্ট শতভাগ ভুয়া ও জালিয়াতির মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে তৈরি করা। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, লিলেন, প্রিন্টিং, অফিস সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য নাছিমা আক্তার ও ঠিকাদারের সাতজন সম্পর্কে আত্মীয়-স্বজন। যেমন- স্বামী, ভাই-বোন ও দেবর।

ভবন নির্মাণ প্রকল্প, হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, লিলেন, প্রিন্টিং, অফিস সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র ইত্যাদি সরবরাহের জন্য একই ঠিকাদারের (হাবিবুর রহমান) সাত আত্মীয়-স্বজন অংশগ্রহণ করেন। যারা পাঁচ টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বিল উত্তোলন করে নিয়ে যান।

প্রতিবেদনের বর্ণনায় বলা হয়, আর্ক কনস্ট্রাকশনের মালিক হাবিবুর রহমান। যে প্রতিষ্ঠান প্রিন্টিংবাবদ ১১ লাখ ২৭ হাজার টাকার বিল উত্তোলন করে নিয়ে যায়। একই ভাবে সারা ট্রেড করপোরেশনের মালিক হেলাল উদ্দিন। যিনি হাবিবুর রহমানের ভাই। এই প্রতিষ্ঠান ২৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার ফার্নিচার সরবরাহের নামে বিলের টাকা নিয়ে যায়। ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকার হাসপাতাল ইকুইপমেন্টের বিল তুলে নেয় বায়োগিয়ার্স। এই প্রতিষ্ঠানের সরাসরি মালিক হাবিবুর রহমান।

নয় লাখ ৯৫ হাজার টাকার অফিস ইকুইপমেন্টের বিল হাতিয়ে নেয় তাহিয়া এন্টারপ্রাইজ। যার মালিক মো. জহিরুল হায়দার। যিনি হাবিবুরের আত্মীয়। হাবিবুরের অফিসের কর্মচারীর প্রতিষ্ঠান জীবন আফরোজ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি পাঁচ লাখ ৮৪ হাজার টাকার লিনেনের কাজের বিল তুলে নেয়। শুধু তা-ই নয়, হাসপাতালের নামে ক্রয় করা জমির মধ্যে ৩.৫ শতাংশ ঠিকাদার হাবিবুর রহমানের নিজের নামে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর নামজারি করা।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বায়োগিয়ার্সের মালিক হাবিবুর রহমান হাসপাতাল ইকুইপমেন্ট সরবরাহ না করায় তাদের বিল না দিয়ে ৭২ লাখ ৬০ হাজার টাকার মালামাল নিজেই ক্রয় করে আইএসিআইবি কর্তৃপক্ষ।

অনিয়মের নানা অভিযোগ ওঠার পর ঠিকাদার হাবিব ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর ১০টি এয়ার কন্ডিশনার (এসি) সরবরাহ করেন। এর আগে ২ নভেম্বর বাউন্ডারি ওয়ালের নির্মাণকাজও শুরু করেন। কিন্তু মাত্র তিনদিনের মাথায় সেই কাজ বন্ধ করে তিনি সরে পড়েন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের নিজস্ব ৬৭.৭০ শতাংশ জমিতে হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে আইএসিআইবি নিজ খরচে একটি ‘প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’ নির্মাণের চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিকাদার হাবিবের পক্ষের একটি গোষ্ঠীর বাধার কারণে সেটি নির্মাণ করা যায়নি

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের নিজস্ব ৬৭.৭০ শতাংশ জমিতে হাসপাতালের মূল ভবনের বাইরে আইএসিআইবি নিজ খরচে একটি ‘প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক স্কুল’ নির্মাণের চেষ্টা করে। কিন্তু ঠিকাদার হাবিবের পক্ষের একটি গোষ্ঠীর বাধার কারণে সেটি নির্মাণ করা যায়নি। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ফাইলেরিয়া ও থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসাসেবা, সাধারণ রোগের চিকিৎসা, প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক শিশুদের সেবা ও শিক্ষাদান, তাদের বেকার মা ও অবহেলিত বেকার নারীদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।

সাভার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিবলীজ্জামান বলেন, সরেজমিনে পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই শেষে যা পেয়েছি তা প্রতিবেদন আকারে দাখিল করেছি। এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থার বিষয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখবেন।

দুদকে পাঠানো অভিযোগে যা বলা হয়েছে

হাসপাতাল নির্মাণকাজের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় শতভাগ জালিয়াতি ছাড়াও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স রাকাব ট্রেড করপোরেশন’ টেন্ডার শিডিউলে উল্লেখিত হাসপাতাল ভবনের পাঁচতলা, বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট নির্মাণ করেনি। হাসপাতালের বেইজমেন্ট ভবনের সামনের জায়গা পাকা করা হয়নি। এছাড়া ৬০টি এয়ার কন্ডিশনার (এসি), ৩৩৬টি সিলিং ফ্যান ও ৪৬৪টি বাল্ব ইত্যাদি সরবরাহ না করাসহ প্রায় ৬৫ শতাংশ কাজ অসমাপ্ত রেখে ভুয়া বিল ও চালান জমা দিয়ে এজি অফিস থেকে প্রকল্পের সম্পূর্ণ টাকা তুলে নিয়ে যায়। সব কাজ অত্যন্ত নিম্নমানের এবং ভবণ নির্মাণের কয়েক দিনের মধ্যে চারটি তলার বিভিন্ন অংশ ফেটে যায়। যা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ২০১৩ সালের ২০ আগস্ট সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ২০১৪ সালের ৮ মার্চ সরেজমিনে পরিদর্শন করে সব জালিয়াতির প্রমাণ পায়। এরপর ওই বছরের ৩০ মে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পরিদর্শন করে সব জালিয়াতির প্রমাণ পেয়ে অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা এবং ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এমনকি এ বিষয়ে ২০১৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পুনরায় তাগিদপত্র পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে সমাজসেবা অধিদফতর পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিলে ২০২০ সালের ৪ মার্চ সাভার উপজেলা সমাজসেবা অফিসার প্রকল্পটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে সমাজসেবার মহাপরিচালককে ওই বছরের ৮ মার্চ রিপোর্ট প্রদান করেন। সেই রিপোর্টে সব অসমাপ্ত কাজের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়। হাসপাতালের নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরিভিত্তিতে বাউন্ডারি ওয়াল ও গেটসহ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সব অসমাপ্ত কাজ সমাপ্তকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সাতটি জাল টেন্ডার ডকুমেন্ট ব্যবহার করে। যেখানে স্বামী-স্ত্রী, ভাই, বোনের ছেলে ও অফিস সহকারীদের টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী হিসেবে দেখানো হয়। টেন্ডারে মাত্র ৩০০ টাকার পে-অর্ডারকে ৩০ লাখ টাকা হিসাবে জমা দেখান হাবিবুর রহমান। তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নাম ও স্বাক্ষর জাল করে রাকাব ট্রেড করপোরেশনের অভিজ্ঞতার সনদ, ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স, অডিট রিপোর্ট, ভুয়া ব্যাংক সলভেন্সি সার্টিফিকেট, সোনালী ব্যাংকের জাল সিল-স্বাক্ষরে চালান ও বিভিন্ন রকম ছবি ব্যবহার করে কাজটি হাতিয়ে নেন। হাসপাতাল ভবন নির্মাণ প্রকল্প ছাড়াও তার (হাবিবুর রহমান) আত্মীয়-স্বজন কর্তৃক যন্ত্রপাতি, লিলেন, প্রিন্টিং, অফিস সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ইত্যাদি সরবরাহ না করে বিল তুলে নিয়ে যায়।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অসমাপ্ত কাজ শুরু করবে বলে ফাইলেরিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় এবং ১০টি এয়ার কন্ডিশনার সরবরাহ করে পুনরায় কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কোনো কাজ হয়নি এবং আইসিআইবি কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি

সর্বশেষ ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অসমাপ্ত কাজ শুরু করবে বলে ফাইলেরিয়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় এবং ১০টি এয়ার কন্ডিশনার সরবরাহ করে পুনরায় কাজ বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কোনো কাজ হয়নি এবং আইসিআইবি কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে ঠিকাদার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

আরএম/এসএম/এমএআর/আইএসএইচ