হাবিব আহসান আকন্দ পেশায় বেসরকারি চাকরিজীবী। নানা কারণে এখনো করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেওয়া হয়নি তার। আজ (শনিবার) সরকার ঘোষিত একদিনে এক কোটি টিকা কার্যক্রমের দিনে তাই রাজধানীর গোড়ানে আলী আহমদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে টিকা নিতে আসেন। কাঠফাটা রোদে বেলা সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে টিকা পান তিনি।

হাবিব আহসান বলেন, আমি আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা পেলাম। তবে অনেকে এসে দশ মিনিটেই টিকা নিয়ে চলে গেছেন। স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের পরিচিতদের ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেন না। অনেকেই লাইনে না দাঁড়িয়ে সোজা ভেতরে গিয়ে টিকা নিচ্ছেন।

হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এ দেশ দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির আখড়া। প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতি। টিকা নিতে এসেও শত শত মানুষ বিড়ম্বনার স্বীকার হচ্ছেন। অনেকেই প্রখর রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও কাঙ্ক্ষিত টিকা দিতে পারেননি। 

ভোগান্তির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে সংবাদকর্মীরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্বজনপ্রীতি আর ভোগান্তির খবরে রাজধানীর গোড়ানের আলী আহমদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা সম্রাটের তোপের মুখে পড়েন দৈনিক আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক আজাদুল আদনান।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কেন্দ্রটিতে ভোগান্তির বিষয়ে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা সম্রাট রেগে গিয়ে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করেন আমি কোথাকার সাংবাদিক! এ সময় তিনি নিজেকেও সাংবাদিক দাবি করেন এবং আমাকে হুমকি দেন। এ সময় তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি আরও উত্তেজিত হয়ে যান। পরে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এসে তাকে সরিয়ে নিয়ে যান।

ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বেলা ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, মানুষের দীর্ঘ লাইন। দাঁড়িয়ে থাকা কেউ কেউ ভোর থেকেই  অপেক্ষায় রয়েছেন। হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও কাউন্সিল ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন মুখ দেখে দেখে নিজেদের লোক ঢুকাচ্ছেন। বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে এটি নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে টিকা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা স্বেচ্ছাসেবকরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেন। 

টিকা নিতে আসা রিকশাচালক মোকাব্বের হোসেন বলেন, লাইনে হাজারো মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও টিকা দেওয়া হচ্ছে মাত্র একটা বুথে। কেন্দ্রে এসে যে যেমনে পারছে টিকা নিচ্ছে। আমি ভোর থেকেই অপেক্ষা করছি। এক পা এগোতে পারিনি।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিরতিহীনভাবে টিকা কার্যক্রম চালানো হবে। কেন্দ্রে যতক্ষণ মানুষ আসবে, ততক্ষণই টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও টিকা কর্মসূচিকে সহজতর করতে গ্রামাঞ্চলে ১৬ হাজার ও শহরাঞ্চলে (পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন) ৮ হাজার ৫০০টি অস্থায়ী টিকা কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোতে প্রায় ৭০ হাজারের মতো ভ্যাক্সিনেটর ও স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।

সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে টিকা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, আমরা এক কোটির যে টার্গেট নিয়েছি, সেটা শেষ করে আরও বেশি দিতে পারব। প্রথম ডোজের জন্য যে টার্গেট নেওয়া হয়েছে তাতে সবাই রেসপন্স করছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধান বলেন, অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, এক দিনেই এক কোটি টিকা! এটাও সম্ভব! আমি বলব যে, হ্যাঁ সম্ভব। যেখানে বিশ্বের ১২৫টির বেশি দেশের মোট জনসংখ্যাই এক কোটির নিচে, সেখানে বাংলাদেশ একদিনেই এক কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগের চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। এর আগে এক দিনে ৮০ লক্ষ মানুষকে টিকা দিয়ে এই সক্ষমতার প্রমাণও দিয়েছে। 

তিনি বলেন, টিকা নিতে সকাল ৮টা থেকেই টিকা কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়ছে ভিড়। সকাল ৯টা থেকেই টিকা দেওয়া শুরু হয়। যতই সময় গড়িয়েছে কেন্দ্রগুলোতে ভিড় বেড়েছে। টিকাদানে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার কারণেই বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের সফলতম দেশের দশম স্থান লাভ করেছে, যা আমাদের জন্য গর্বের।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, আমাদের দেশের স্বাস্থ্যখাত এই করোনা মোকাবিলায় অকল্পনীয় কারিশমা দেখিয়েছে। দেশের মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। 

জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ৬৭৫টি কেন্দ্রে কোভিড-১৯ গণটিকা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি ওয়ার্ডে ৯টি করে কেন্দ্র হিসেবে সর্বমোট ৬৭৫ কেন্দ্রে এই টিকাদান কার্যক্রম চলছে। প্রতি কেন্দ্রে ৫০০ জনকে টিকা প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরিচালিত হতে যাওয়া এই কার্যক্রমে সর্বমোট ৩ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ জনকে টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই অবস্থা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কেন্দ্রগুলোতেও।

এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, চলমান কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ন্ত্রণকল্পে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে ১ম ডোজের আওতায় আনতেই দেশব্যাপী ‘একদিনে এক কোটি কোভিড-১৯ টিকাদান কার্যক্রম’ হাতে নিয়েছে সরকার। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সরকার দেশের সকলকে ১ম ডোজ কোভিড-১৯ টিকা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও বুস্টার ডোজ প্রদান কার্যক্রমও জোরদার করা হবে। এ কার্যক্রমের আওতায় জনসাধারণের টিকাগ্রহণ সহজতর করতে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সকলেই ১ম ডোজ টিকা গ্রহণ করতে পারবেন।

টিআই/এইচকে