করোনাভাইরাস, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, এইডসসহ নানা জটিল ও সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের সবচেয়ে কাছ থেকে সেবা দিয়ে থাকেন নার্স-মিডওয়াইফরা। এ ক্ষেত্রে রোগীর সংস্পর্শে এসে তাদের অনেকে আক্রান্ত হন, আক্রান্ত হয়ে অনেকের প্রাণও যায়। তবে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা সম্মুখসারির এ যোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে নেই কোনো ঝুঁকিভাতা।

জানা গেছে, করোনা মোকাবিলায় ঢাকা মহানগরের ১৫ সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা বিভাগের ১৪ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৩ হাসপাতাল, রংপুর বিভাগে ১৩ হাসপাতালসহ দেশের আট বিভাগে মোট ৭৯টি সরকারি হাসপাতালে নার্সরা কাজ করছেন।

এ ছাড়া, জেলা-উপজেলাসহ প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই করোনার নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন নার্সরা। করোনায় চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেশে প্রায় সাত হাজার নার্স আক্রান্ত হয়েছেন। ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

জেলা পর্যায়ে ৫০টির মতো বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, পাঁচটি বিভাগে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, ঢাকার শ্যামলীতে ২৫০ শয্যার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মহাখালীতে কুষ্ঠ হাসপাতাল এবং জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, চন্দ্রঘোনা ও লালমনিরহাটে কুষ্ঠ হাসপাতাল, মহাখালীতে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালে যে নার্সরা নিয়োজিত আছেন, তাদের বেশিরভাগকে রোগীর কাছাকাছি যেতেই হয়। এতে তাদের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থেকেই যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকার উপায় নেই বললেই চলে। তবুও হাসপাতালগুলোতে করোনা, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, এইডস, বসন্তসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন ছোঁয়াচে ও জটিল রোগে আক্রান্তদের সেবা দিয়ে আসছেন নার্সরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত এক নার্স বলেন, কোনো একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে হাসপাতাল হয়তো আমাকে ওষুধ ফ্রি দেবে, কিন্তু রোগটা যে আমার মধ্যে বাসা বেঁধে ক্ষতিসাধন করল, আমার পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করল— এসব বিবেচনায় আমাদের জন্য কোনো ঝুঁকিভাতা নেই, এটি কষ্টদায়ক।

রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড ডিএনসিসি হাসপাতালে কর্তব্যরত মিডওয়াইফ তানিয়া সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলা পর্যায়ে আমাদের পোস্টিং হলেও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমাকে বদলি করা হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে। শুরু থেকেই ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু এ ঝুঁকি যেন অনেকটাই মূল্যহীন।

তিনি বলেন, শুধু করোনা নয়, আমরা নার্সরা সব ধরনের রোগে আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকি। অন্যান্য পেশায় ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা ঝুঁকিভাতা পেলেও আমাদের কেন সেটি দেওয়া হয় না, এটাই বড় প্রশ্ন।

এ বিষয়ে স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের (স্বানাপ) মহাসচিব ইকবাল হোসেন সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, অন্যান্য পেশায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য আলাদা ঝুঁকি ভাতা থাকলেও নার্সদের কোনো ঝুঁকিভাতা নেই। অথচ, একজন নার্সকেই সবসময় নানা ঝুঁকিপূর্ণ ও মারাত্মক রোগে আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসতে হয়।

তিনি বলেন, মহামারি মোকাবিলায় নার্সরা সবসময় সম্মুখসারিতে থাকেন। করোনার সময়ে আমরা দিনরাত রোগীদের সেবায় কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। সরকারের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন, অবিলম্বে নার্সদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হোক। সেইসঙ্গে পুলিশ, সৈনাবাহিনীসহ সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর মতো আমাদের জন্যও ঝুঁকিভাতার ব্যবস্থা করা হোক।

সুযোগ-সুবিধা আর নার্সিংয়ে জনবল সংকট নিরসন না করলে আগামী ২০০ বছরেও এ পেশার উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেও মনে করেন পেশাজীবী এ নেতা।

তিনি আরও বলেন, আমাদের নার্সদের শুরুতেই বেতন ধরা উচিত কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। কারণ, যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হলে স্বাস্থ্যে যারা জড়িত, আগে তাদের শান্তি প্রয়োজন। মনে যদি শান্তি না থাকে, তাহলে তো একজন নার্সের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা আমরা আশা করতে পারি না। এর প্রভাব তো রোগীর ওপরও পড়তে পারে।

সোসাইটি ফর নার্সেস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির মাহমুদ তিহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাইট শিফটসহ আমাদের একজন নার্সকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। অনেক জটিল রোগের ঝুঁকি থাকে। যদিও এটি শ্রম আইনের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ, তারপরও আমাদের বাধ্য হয়েই করতে হয়। যদিও এখন শোনা যাচ্ছে, আট ঘণ্টা করে ডিউটি ফিক্সড হবে, কিন্তু এখনও কোথাও এর বাস্তবায়ন দেখিনি।

দিনে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করলে আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে স্বাস্থ্যকর্মীদের আলাদা ইনসেনটিভ দেওয়া হলেও আমাদের ক্ষেত্রে বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। নার্সরা ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে কাজ করলেও কোনো ঝুঁকিভাতা দেওয়া হয় না।

সাব্বির মাহমুদ আরও বলেন, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন ফোর্স ঝুঁকিভাতা পেয়ে থাকে। তাদের মতো কিন্তু আমাদেরও ঝুঁকি আছে, যেমন একজন এইডস আক্রান্ত রোগী সে যদি তার রোগের কথা আমাকে না বলে, তাহলে তার থেকে বিভিন্ন ইনজুরির মাধ্যমে সেই রোগটি আমার দেহেও আসার শঙ্কা থাকে। করোনাভাইরাসের সময়ে আমাদের অনেক নার্স রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, কয়েকজন তো মারাও গেছেন। সবমিলিয়ে চিকিৎসা পেশায় আমাদের ঝুঁকি অনেক, কিন্তু কোনো ভাতা নেই।

নার্স নেতারা আরও বলেন, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকিভাতা পাচ্ছে, তারা পেলে সংক্রামক রোগ চিকিৎসার সঙ্গে যুক্তরা কেন পাবে না?

এসব বিষয়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারের ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

টিআই/আরএইচ/ওএফ