স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লকডাউন প্রস্তাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর না
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বগতি পরিস্থিতিতে সারাদেশে আবারও কঠোর লকডাউন নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা নেই।
বুধবার (১৭ মার্চ) সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে পুনরায় লকডাউনসহ কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও বর্তমানে করণীয় সম্পর্কে গতকাল (মঙ্গলবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সভায় ১২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। পরে এসব বিষয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
এদিকে, বুধবার (১৭ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর বিসিপিএস কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে লকডাউন প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আপাতত লকডাউনের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, করোনা সংক্রমণের এ ঊর্ধ্বগতি রুখতে ১২ দফা সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তার মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, যে কোনো পাবলিক পরীক্ষা যেমন- বিসিএস, এসএসসি, এইচএসসিসহ অন্যান্য পরীক্ষা বন্ধ রাখা।
প্রস্তাবগুলো হলো-
১. সম্ভব হলে কমপ্লিট লকডাউনে যেতে হবে। সম্ভব না হলে ইকোনমিক ব্যালেন্স রেখে যেকোনো জনসমাগম বন্ধ করতে হবে।
২. কাঁচা বাজার, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, শপিংমল, মসজিদ, রাজনৈতিক সমাগম, ভোট অনুষ্ঠান, ওয়াজ মাহফিল, পবিত্র রমজান মাসের ইফতার মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান সীমিত করতে হবে।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেগুলো বন্ধ রয়েছে সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে। অন্যান্য কার্যক্রম সীমিত রাখতে হবে।
৪. যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা (বিসিএস, এসএসমি, এইচএসসি, মাদ্রাসা, দখিলসহ অন্যান্য) বন্ধ রাখতে হবে।
৫. কোভিড পজিটিভ রোগীদের আইসোলেশন জোরদার করা।
৬. যারা রোগীদের কন্ট্রাকে আসবে তাদের কঠোর কোয়ারেন্টাইনে রাখা।
৭. বিদেশ থেকে বা প্রবাসী যারা আসবেন তাদের ১৪ দিনের কঠোর কোয়ারেন্টাইনে রাখা এবং এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর সহায়তা নেওয়া।
৮. আগামী ঈদের ছুটি কমিয়ে আনা।
৯. স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে আইন প্রয়োজনে জোরদার করা।
১০. পোর্ট অব এন্ট্রিতে জনবল বাড়ানো, মনিটরিং জোরদার করা।
১১. সব ধরনের সভা ভার্চুয়াল করা।
১২. পর্যটন এলাকায় চলাচল সীমিত করা।
এসব প্রস্তাবের পাশাপাশি কয়েকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও ৫টি প্রস্তাব দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন- বইমেলা বাতিল করতে হবে, বদ্ধস্থানে বা কক্ষে ইফতার পার্টি না করতে নির্দেশনা দিতে হবে, ঈদের ছুটি কমিয়ে একদিন করতে হবে, কক্সবাজারসহ পর্যটন এলাকায় যাতায়াত সীমিত করতে হবে এবং মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নামাজের ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে, লকডাউনসহ সুনির্দিষ্ট বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো প্রস্তাব মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'কোথায় আপনি এরকম মিটিংয়ের কথা শুনলেন? এরকম কোনো মিটিংয়ের ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানি না। ফের লকডাউন, পরীক্ষা বন্ধ থাকা বা বইমেলার বিষয়ে কোনো প্রস্তাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোথাও যায়নি।'
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরাসহ সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি জোরদার করার বিষয়ে ও সব জায়গায় মাস্ক পরার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মসজিদ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাস্ক পরবে, বইমেলা হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। সবজায়গায় স্বাস্থ্যবিধিটাকে জোরদার ও কার্যকর করার জন্য আমাদের কাছেও নির্দেশনা এসেছে।'
এদিকে, জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'আমি জানি না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এভাবে নিজেরাই মিটিং করে প্রস্তাব দিয়ে দিতে পারে কি না। যদি তারা টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের ছাড়াই এসব জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে, তাহলে আর আমাদের দরকার কী? তারাই সব করুক।'
তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে যদি মন্ত্রণালয়কে লডকাউন করার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়ে থাকে, তাহলে আমি বলবো যে, তারা ভুল প্রস্তাব দিয়েছে। এ মুহূর্তে কোনো ক্রমেই লকডাউন করা যাবে না। তাছাড়া স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। মূল গুরুত্ব দিতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপরে এবং সেটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে অনেক কিছু করতে হবে না।'
এর আগে গতকাল (মঙ্গলবার) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, হঠাৎ করেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলেছে। কয়েকদিন ধরে শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে লকডাউন দেওয়ার চিন্তা নেই।
তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনের বিষয়ে আমাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় নাই। তবে আগের যে স্বাস্থ্যবিধি ছিল, সেগুলো বেশি বেশি করে মানা, সেগুলো প্রচার করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- রেস্তোরাঁ, পরিবহনে ভিড় এড়ানো, সবাইকে মাস্ক পরানো, পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় যেন লোকজন ভিড় না করে।’
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করণীয় বিষয়ে বৈঠকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যের ডিজি বলেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার ওপর। এজন্য প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
টিআইি/এসএম