দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কখনোই জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রিক ছিল না এবং এখনও হয়ে উঠেনি। দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এমনটাই মনে করছেন।

তারা বলেন, ফেব্রুয়ারিতে দেশে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুহার অনেক কমে গেলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণকে বার্তা দেন যে সংক্রমণ প্রায় শূন্য, করোনা জয় করার পথে। সাধারণ মানুষের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং তারা স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েন।

রোববার (১৮ এপ্রিল) স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত ‘চিকিৎসায় অব্যবস্থাপনা, কঠোর লকডাউন, কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ?’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে আলোচকরা এসব মতামত ব্যক্ত করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে সুন্দর অভিজ্ঞতা রয়েছে, সে হিসেবে যেভাবে করোনা মোকাবিলা করা হয়েছে তার চেয়ে আরও সুন্দরভাবে করা উচিত ছিল। এছাড়াও মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হলেও কী ধরনের মাস্ক পরবে এবং কী উপায়ে পরবে তা নিয়ে সেভাবে বলা হচ্ছে না। অথচ সঠিক নিয়ম না মেনে মাস্ক পরা অর্থহীন। বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই মনে করেন করোনা তাদের অসুখ নয়। এছাড়া ভ্যাকসিন কোন প্রতিষ্ঠানের তৈরি, কোন দেশ থেকে আসছে এসব নিয়েও নানা মতভেদ রয়েছে। কোন ভ্যাকসিনই শতভাগ নিরাপত্তা দিতে পারে না৷ কিন্তু ভ্যাকসিন নিলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দারের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ডা. শাহ মুনির হোসাইন, ব্র‍্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস পি গ্র‍্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক ডা. মালবিকা সরকার এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার মিত্র।

শুরুতেই ডা. মালবিকা স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, দেশে করোনাকেন্দ্রিক বর্তমান ভয়াবহ অবস্থার কারণ তিনটি। প্রথমত- মানুষ স্বাস্থ্যবিধি ভালোভাবে মানছে না, দ্বিতীয়ত- ইউকে বা সাউথ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্ট যখন দেশে এলো তখন যথাযথ সময়ে ফ্লাইট বন্ধ করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে, তৃতীয়ত- স্বাস্থ্যসেবা খাতে নানান অব্যবস্থাপনা।

ডা. মুনির বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে বিদেশফেরত অনেককে কোয়ারেন্টিনে রাখা হলেও পরবর্তীতে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগতদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে না পারার ব্যর্থতায় দেশে করোনা ছড়িয়েছে। এই ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে অন্যান্য খাতের সমন্বয় নেই। তাছাড়া শুরুতেই কন্টাক্ট ট্রেসিং করে আইসোলেশন নিশ্চিতের মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ করা যায়নি। এখন কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে পড়ায় তা আর সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, প্রথমে দেশে যে লকডাউন ছিল, সেটা আসলে সাধারণ ছুটি ছিল। এতে লকডাউনের ফল পাওয়া যায়নি। সংক্রমণের হার চিহ্নিত করে রেডজোন, ইয়েলো জোন ইত্যাদির প্রস্তাব দেওয়া হলেও জীবন নাকি জীবিকার প্রশ্ন তুলে নীতিনির্ধারকরা সেটা নিয়ে কাজ করেননি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, নীতিনির্ধারক কারা? তারা কি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ? তারা কি চিকিৎসক? নাকি তারা প্রশাসক, আমলা বা রাজনৈতিক নেতা? টেকনিক্যাল এক্সপার্টদের উপদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা থাকলেও কখনোই তা করা হয়নি। তাছাড়াও করোনা মোকাবিলায় সরকারি এবং বেসরকারি খাত ভিন্নভাবে কাজ করছে। দুই খাতের কাজ করার ধরনের পার্থক্যও বিশাল। এ বিষয়ে নজর দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, এনজিওদেরও সেভাবে সম্পৃক্ত করা যায়নি। বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেবা নয়, বাণিজ্যিক দিকটাই বেশি দেখেছে। শুধু চিকিৎসকই নন, তৃণমূলের স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবন দিয়ে কাজ করে গেলেও সেভাবে তাদের কোনো প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। সব মিলিয়ে শুরু থেকেই সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে সংক্রমণ অনেক কমানো যেতো। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কখনোই জনস্বাস্থ্যকেন্দ্রিক না হওয়াটাও এসবের পেছনে একটা বড় কারণ। 

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে আগেই বলা হয়েছিল, এরকম হতে পারে। অথচ ফেব্রুয়ারিতে যখন দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছিল তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণকে এমন বার্তা দিলেন যে সংক্রমণ প্রায় শূন্য, করোনা জয় করার পথে। সাধারণ মানুষের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং তারা স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে।

করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বের ঘাটতি ফুটে উঠেছে বলে মনে করেন ডা. দীপক। তিনি বলেন, প্রথম দফায় ইন্টারন্যাশনাল বাউন্ডারি লকডাউনের ক্ষেত্রে যে ভুল করা হয়েছিল এখন আবার দ্বিতীয়বার তা করা হয়েছে, যেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে যে সুন্দর অভিজ্ঞতা রয়েছে সে হিসেবে যেভাবে করোনা মোকাবিলা করা হয়েছে তার চেয়ে আরও সুন্দরভাবে করা উচিত ছিল।

বাতাসের মাধ্যমেও করোনা ছড়ায় সম্প্রতি এমন একটি কথা শোনা যাচ্ছে, তাহলে মাস্ক পড়াসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোন লাভ আছে কি না একজন দর্শকের এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুনির বলেন, এটা যদি সত্যও হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে মাস্ক পরা তো ছাড়াই যাবে না বরং মাস্ক আরও বেশি করে পরতে হবে। তিনি বলেন, শুধু বলা হচ্ছে- মাস্ক পরুন, কিন্তু কী ধরনের মাস্ক পরবে এবং কী উপায়ে পরবে তা নিয়ে কিন্তু সেভাবে বলা হচ্ছে না যা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ সঠিক নিয়ম না মেনে মাস্ক পরা অর্থহীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রতি দেশের একটা বড় অংশের অনীহা প্রসঙ্গে ডা. মালবিকা বলেন, বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই মনে করেন করোনা তাদের অসুখ নয়। এছাড়া ভ্যাকসিন কোন প্রতিষ্ঠানের তৈরি, কোন দেশ থেকে আসছে এসব নিয়েও নানা মতভেদ রয়েছে।

অ্যাপের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের জন্য রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডা. মুনির প্রশ্ন রাখেন, কতজন নাগরিকের এই সুবিধা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে? তাই অন স্পট রেজিস্ট্রেশন বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা কিংবা কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। মানবসম্পদ ঠিকভাবে কাজে লাগাতে না পারলে শহর অঞ্চলে যে হারে ভ্যাকসিন দেওয়া যাচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেভাবে দেওয়া যাবে না।

তিনি আরও বলেন, কোভ্যাক্স থেকে প্রতিশ্রুত ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে এবং সেরাম থেকে ক্রয় করা মোট ভ্যাকসিন পাওয়া গেলে সেগুলো মজুদ করার ব্যবস্থা আছে কি না তা নিয়েও ভাবতে হবে। মানুষকে কেন ভ্যাকসিন নিতে হবে সে সম্পর্কে তাদের জানাতে-বুঝাতে হবে। ভ্যাকসিন নিয়েও অনেকে মারা যাচ্ছেন বলা হচ্ছে কিন্তু প্রথম ডোজ নেয়ার পরই কেউ পুরোপুরি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেন না। দুই ডোজ নেয়ার পরও কোন ভ্যাকসিনই শতভাগ নিরাপত্তা দিতে পারে না৷ কিন্তু ভ্যাকসিন নিলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। ভ্যাকসিন নিলে ব্লাড কট হবার সম্ভাবনা নাম মাত্র। কিন্তু না নিলে সে সম্ভাবনা বহুগুণ বেশি। মানুষ যেন ভ্যাকসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে আতঙ্কিত না হয় সেজন্য তাদের সচেতন করতে হবে। সব মিলিয়ে ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কমিউনিকেশন আরও জোরদার করতে হবে।

ডা. দীপক মনে করেন, এখন থেকেই সবাইকে মাস্ক পরায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- কেউ মাস্ক না পরলে তার সঙ্গে কথা না বললে, দোকানি মাস্ক না পরলে সে দোকান থেকে কিছু না কিনলে তারা মাস্ক পরতে বাধ্য হবেন। জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে টিকা দেয়া হলে অ্যাপ এর কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

করোনার ভ্যাকসিন যদি প্রতি বছরই দিতে হয়ে সেক্ষেত্রে সরকারের কী করা উচিত সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মালবিকা বলেন, লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। ডা. মুনির বলেন, প্রথমত- মাইক্রোপ্ল্যানিং করতে হবে যে, কার ভ্যাকসিন প্রয়োজন আর কার নয়, সে হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, দ্বিতীয়ত- মানবসম্পদ উন্নয়ন, তৃতীয়ত- বেসরকারি খাত ও এনজিওদের সম্পৃক্তকরণ। ডা. দীপক মনে করেন, লিডারশিপসহ সবকিছুরই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। কেননা সবকিছু ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।

টিআই/আরএইচ