বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) ও এর অধীন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে শূন্য পদে দ্রুত নিয়োগ, হাসপাতালটি পূর্ণমাত্রায় চালু এবং রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের জন্য হোস্টেল ও লাইব্রেরি সুবিধা নিশ্চিত করার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন চিকিৎসকরা। 

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পূর্ণরূপে দ্রুত চালু এবং বিএমইউতে দ্রুততম সময়ে চিকিৎসক নিয়োগের কোনো সিদ্ধান্ত না এলে কর্মবিরতিসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

আজ (মঙ্গলবার) শাহবাগের বিএমইউ ক্যাম্পাসে “সচেতন চিকিৎসক সমাজ”-এর ব্যানারে আয়োজিত এই মানববন্ধনে বিভিন্ন বিভাগ, ইউনিট ও হাসপাতালের শিক্ষক, রেসিডেন্ট চিকিৎসক এবং ট্রেইনি ডাক্তাররা অংশ নেন।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, কোরিয়ার অর্থায়নে নির্মিত সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্টের অভাবে হাসপাতালটি এখনো পূর্ণমাত্রায় চালু হয়নি। উন্নত যন্ত্রপাতি ও ওয়ার্ডগুলো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে, যার ফলে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে।

অফথালমোলজি বিভাগের রেসিডেন্ট ডা. মো. নাজমুল হাসান বলেন, “এই হাসপাতাল চালু হলে শুধু রোগীরা নয়, মেডিকেল শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হতেন। কিন্তু পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও মেডিকেল অফিসার না থাকায় অনেক ইউনিটই খোলা যাচ্ছে না। আমরা চাই—অবিলম্বে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হোক।”

তিনি বলেন, “৫ আগস্টের পর দেশে যেভাবে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক সংস্কার শুরু হয়েছে, বিএমইউ সেই পরিবর্তনের বাইরে থাকা উচিত নয়। এটি দেশের একমাত্র সুপার স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয়; তাই এটিকে সচল রাখার দায়িত্ব সরকারের।”

রেসিডেন্টদের আবাসন ও একাডেমিক সংকট
মানববন্ধনে চিকিৎসকরা আরও অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত রেসিডেন্ট চিকিৎসককে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় কষ্ট করে থাকতে হয়। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো হোস্টেল নেই, ফলে সময় মতো ডিউটিতে পৌঁছানো ও রাতের জরুরি সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ডা. মাহমুদুর রহমান মাজেদ বলেন, “বিএমইউর ছাত্রাবাসগুলো নামকাওয়াস্তে আছে। থাকার পরিবেশ নেই, নিরাপত্তা নেই। অথচ রেসিডেন্ট চিকিৎসকরাই হাসপাতাল চালিয়ে রাখছেন দিনরাত।”

তারা বলেন, আধুনিক লাইব্রেরি ও একাডেমিক সাপোর্টের অভাবে গবেষণাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দেশীয় চিকিৎসা গবেষণায় নতুন জ্ঞান বা উদ্ভাবনের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না।

চিকিৎসা শিক্ষা ও জনস্বার্থে দাবি
চিকিৎসকরা মনে করেন, শূন্যপদ পূরণ ও হাসপাতাল সচল করা কেবল চিকিৎসকদের দাবি নয়, এটি জনস্বার্থের বিষয়। কারণ হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু হলে দেশের সাধারণ মানুষ আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্যসেবা পাবেন এবং তরুণ চিকিৎসকেরা উন্নত প্রশিক্ষণ লাভ করবেন।

ডা. আবু ইউসুফ আব্দুল্লাহ বলেন, ৫ আগস্টের পর সব জায়গায় সংস্কার হচ্ছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনও ঠিক মতো সংস্কার করা হয়নি। নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। কোরিয়ার অর্থায়নে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করা হয়েছে, এখনও পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না দেশের জনগণ। চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট-ওয়ার্ড বয়সহ সব পদে নিয়োগ করে পুরোপুরিভাবে হাসপাতাল চালু করা হোক। 

তিন দফা দাবি 
চিকিৎসকদের তিন দফা দাবিগুলো হলো—
১. শিক্ষক ও মেডিকেল অফিসার নিয়োগ: বিশ্ববিদ্যালয় ও এর অধীনস্থ হাসপাতালগুলোতে বহু শিক্ষক ও মেডিকেল অফিসারের পদ দীর্ঘদিন যাবৎ শূন্য রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এর ফলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা উভয়ই বিঘ্নিত হচ্ছে। অবিলম্বে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শূন্য পদে নিয়োগ কার্যক্রম শুরু এবং প্রয়োজনে নতুন পদ সৃজন করতে হবে।

২. সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পূর্ণমাত্রায় চালু: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও কর্মীর অভাবে পূর্ণমাত্রায় কার্যকর নয়। এতে রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা প্রয়োজনীয় ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন না। জাতীয় স্বার্থে হাসপাতালটি সম্পূর্ণভাবে চালু করে সর্বোচ্চ মানের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।

৩. পূর্ণাঙ্গ হোস্টেল নির্মাণ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ: বর্তমানে রেসিডেন্ট ও ট্রেইনি ডাক্তারদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো হোস্টেল সুবিধা নেই, ফলে তারা নিরাপদ ও উপযুক্ত আবাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ ছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন লাইব্রেরি ও একাডেমিক সাপোর্ট সিস্টেমেরও অভাব রয়েছে। দ্রুত সময়ে পূর্ণাঙ্গ হোস্টেল নির্মাণ এবং আধুনিক লাইব্রেরি স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে

বক্তারা বলেন, এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হলে বাংলাদেশ চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। অন্যথায়, বিএমইউর সম্ভাবনা স্থবির হয়ে পড়বে।

মানববন্ধনে বিএমইউর ডা. আবুল বাশার, ডা. নাজমুল হাসান, ডা. আবু রায়হান রাজি, ডা. মাহমুদুর রহমান মাজেদসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকরা অংশ নেন।

তারা ঘোষণা দেন, নভেম্বরের মধ্যেই সরকারের সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ না এলে ডিসেম্বর থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি, প্রতীকী ধর্মঘট এবং প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।

টিআই/এনএফ