বাংলাদেশেও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে চীনের স্মার্ট হাসপাতাল মডেল
বিশ্ব রেকর্ডসংখ্যক লিভার প্রতিস্থাপন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্রোপচার এবং সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা— চীনের স্বাস্থ্যখাতের এসব অগ্রগতি এখন বাংলাদেশের জন্যও বাস্তব সম্ভাবনা হিসেবে সামনে আসছে বলে জানিয়েছেন মেডিকেল ট্যুরিজম সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সঠিক সহযোগিতা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশও চীনের আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর মডেল থেকে উপকৃত হতে পারে।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) রাতে রাজধানীর রেডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেনে ডামিয়াং মেডিক্যাল টেকনোলজি (সুজৌ) কোম্পানি লিমিটেডের বাংলাদেশ শাখা আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তারা এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে আধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা পর্যটন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত তুলে ধরতে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি ও চিকিৎসা পর্যটনে নতুন সম্ভাবনা।
বিজ্ঞাপন
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। এসময় দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রোগীরা এখনো অনেক জটিল রোগের ক্ষেত্রে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে বাধ্য হন। চীনের স্মার্ট হাসপাতাল ব্যবস্থা, আধুনিক অস্ত্রোপচার পদ্ধতি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, স্বাস্থ্যখাতে চীন–বাংলাদেশ সহযোগিতা শুধু চিকিৎসা সেবায় নয়, বরং প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজ্ঞাপন
ডামিয়াং মেডিকেল টেকনোলজির জেনারেল ডিরেক্টর ড. জ্যাক ঝাং বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি ব্যবহারের কৌশল তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ডামিয়াং মেডিকেল টেকনোলজি একটি অংশীদার হিসেবে কাজ করতে চায়।
মূল উপস্থাপনায় ড. জ্যাক ঝাং জানান, সাংহাইয়ের লেন্টি হাসপাতাল চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য র্যাকিংয়ে সর্বোচ্চ ‘এ প্লাস প্লাস প্লাস’ গ্রেডপ্রাপ্ত এবং দেশটির শীর্ষ বিশটি হাসপাতালের একটি। বৈশ্বিক হাসপাতাল তালিকায়ও এটি শীর্ষ দুই শত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্থান পেয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে নেচার সূচক অনুযায়ী, বৈশ্বিক প্রভাবের দিক থেকে লেন্টি হাসপাতাল চীনের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শীর্ষ তিনটির একটি।
উপস্থাপনায় বলা হয়, চিকিৎসা সাফল্যের ক্ষেত্রে লেন্টি হাসপাতাল টানা এগারো বছর ধরে শিশুদের লিভার প্রতিস্থাপনে বিশ্ব নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। একই সঙ্গে তারা ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত উন্নত ‘কার টি-সেল থেরাপি’তেও সক্রিয়। প্রযুক্তি ব্যবহারে হাসপাতালটি আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। সেখানে ‘ডেনি’ নামের রোবটিক অস্ত্রোপচার ব্যবস্থার মাধ্যমে দূরবর্তী অস্ত্রোপচারের উদাহরণ তুলে ধরা হয়, যেখানে বিদেশ থেকে অপারেশনের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
অন্যদিকে, সাংহাই জিয়াও তং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সঙ্গে যুক্ত রেনজি হাসপাতাল লিভার প্রতিস্থাপনে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। হাসপাতালটি এরইমধ্যে আট হাজারেরও বেশি লিভার প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালটি বর্তমানে চারটি ক্যাম্পাসে পরিচালিত হচ্ছে এবং প্রায় তিন হাজার শয্যা ও চুয়ান্নটি বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।
জ্যাক ঝাং বলেন, গত বছরে রেনজি হাসপাতাল প্রায় সত্তর লাখ বহির্বিভাগ ও জরুরি রোগীকে সেবা দিয়েছে এবং এক লাখ আঠারো হাজারের বেশি অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছে। গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগসহ তেরোটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে হাসপাতালটি চীনের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য রেনজি হাসপাতাল প্রায় দুই দশক ধরে বিশেষায়িত সেবা দিয়ে আসছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বত্রিশটি বিমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি বিলিং সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিকমান নিশ্চিত করতে তারা ‘ডিএনভি’ নামের একটি আন্তর্জাতিক গুণগতমান নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বীকৃতি অর্জন করেছে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ডামিয়াং মেডিকেল টেকনোলজির বাংলাদেশ শাখার কান্ট্রি ডিরেক্টর হোমায়রা নূর। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ও অর্থনৈতিক খাতে চীনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা এবং বাংলাদেশের জনশক্তির সমন্বয় দুই দেশের জনগণের জন্যই ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। তার ভাষায়, এই সেমিনার সেই যৌথ যাত্রার একটি বাস্তব সূচনা।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে বক্তারা আরও জানান, রেনজি হাসপাতাল এখন ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ও স্মার্ট হাসপাতাল কাঠামোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর অস্ত্রোপচার ভবন, স্বয়ংক্রিয় রোগী ব্যবস্থাপনা এবং তথ্যভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও নিরাপদ ও কার্যকর করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে কর্তৃপক্ষ।
টিআই/জেডএস