করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলিয়ে সাড়ে ছয় কোটির বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশের করোনা পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। এজন্য টিকার তৃতীয় অর্থাৎ বুস্টার ডোজ দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন অনেকে। তবে বাংলাদেশে বুস্টার ডোজ দেওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ ও করোনা বিষয়ে গবেষক ডা. আশরাফুল হকও এমনটাই মনে করেন। 

দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতি, টিকা কার্যক্রম ও গবেষণাসহ নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : টিকার কার্যকারিতা ও অ্যান্টিবডি নিয়ে আপনার গবেষণার বিষয়ে জানতে চাই…

ডা. আশরাফুল হক : দেশে প্রথম অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি কোভিশিল্ড টিকা প্রয়োগ শুরু হয়েছিল গত ৭ ফেব্রুয়ারি। তারপর থেকে যারা টিকা নিয়েছেন এমন ৫০০ জনের ওপর আমরা টিকার অ্যান্টিবডি বা কার্যকারিতা দেখার গবেষণা চালাই। তাদের অবশ্য এখনও সবার ছয় মাস পূর্ণ হয়নি। কিন্তু যাদের ছয় মাসের কাছাকাছি অথবা পূর্ণ হয়েছে তাদের ওপর আমরা ছয় মাসের যে ফলোআপ পেয়েছি, তার অংশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে যাদের কোমরবিডিটি অর্থাৎ ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, ক্যান্সার বা লিভারজনিত সমস্যাসহ এমন কিছু রোগ ছিল না এবং যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে, তাদের কোভিশিল্ড টিকার দুই ডোজ দেওয়ার পর যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেটি আসলে খুব বেশি কমে যায়নি।

বুস্টার ডোজ নিয়ে এ মুহূর্তে চিন্তাভাবনা না করলেও চলবে। আমরা দুই ডোজেই আস্থা রাখতে পারি— বলছেন ডা. আশরাফুল হক

হয়তো তাদের শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, সেটি আরও দীর্ঘদিন থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা আশা করছি, তাদের এ প্রতিরোধ ক্ষমতা নয় থেকে ১২ মাসও থেকে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যাদের বয়স ৬৫ বছরের ওপরে এবং যাদের কোমরবিড কন্ডিশন (অন্য রোগে আক্রান্ত) ছিল, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে অ্যান্টিবডি যতটুকু তৈরি হয়েছিল সেটি গতানুগতিকভাবে অন্যদের তুলনায় কম ছিল। ছয় মাস পর সেটি ধীরে ধীরে অনেকটা কমে এসেছে।

ঢাকা পোস্ট : কোভিশিল্ড টিকাগ্রহীতাদের বুস্টার ডোজ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই…

ডা. আশরাফুল হক : যাদের বয়স ৬৫ বছরের উপরে এবং যাদের কোমরবিড কন্ডিশন আছে, তাদের ক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। কিন্তু এটি আসলে জরুরি বা একেবারে বাধ্যতামূলক নয়। বর্তমানে তাদের শরীরে যে পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, তা দিয়েও শরীরে কোভিড প্রতিরোধের স্বাভাবিক যে মাত্রা সেটি ধরে রাখা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বুস্টার ডোজ দেওয়ার যে প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করছি, সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনা না করলেও চলবে। এ মুহূর্তে আমরা টিকার দুই ডোজেই আস্থা রাখতে পারি।

গত ১৩ জুলাই থেকে দেশে মডার্নার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। এ টিকা গ্রহণকারী ১০০ জনের ফলোআপ করার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। এতে দেখা গেছে, কোভিশিল্ডের তুলনায় মডার্নার টিকা দ্বিগুণের বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম। বিশেষ করে যাদের বয়স ৬৫ বছরের উপরে এবং ডায়াবেটিস, প্রেশারসহ অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে।

ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফুল হক / ছবি- ঢাকা পোস্ট

১০০ জনের মধ্যে ৭২ পুরুষ ও ২৮ নারী ছিলেন। তাদের সবারই কোমরবিড কন্ডিশন ছিল। সেদিক থেকে বলা যায় যে মডার্নার এমআরএনএ টিকাটি যদি ৬৫ বছরের বেশি বয়সী যাদের কোমরবিড কন্ডিশন রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর হারও অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অন্য যে টিকাগুলো রয়েছে সেগুলো গতানুগতিকভাবে কোমরবিড কন্ডিশন নেই এবং যাদের বয়স কম তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। যাদের কোমরবিড কন্ডিশন রয়েছে, তাদের এমআরএনএ টিকা দিলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যাবে।

ঢাকা পোস্ট : কোভিশিল্ড নিয়ে আপনার পুরো গবেষণা কবে নাগাদ শেষ হবে এবং চূড়ান্ত ফল কবে নাগাদ আমরা জানতে পারব?

ডা. আশরাফুল হক : পুরো গবেষণাটি শেষ হতে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, অনেকেই করোনা সংক্রমণের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে টিকা নিতে পারেননি। অনেককে আবার প্রথম ডোজের টিকা নিয়ে দ্বিতীয়টি একটু দেরিতে নিতে হয়েছে। যে কারণে তাদের ছয় মাস সম্পন্ন হতে একটু সময় লাগছে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ আমাদের গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যাওয়া লাগতে পারে। নভেম্বরে হয়তো আমরা চূড়ান্তভাবে ফল প্রস্তুত করতে পারব এবং আপনাদের জানাতে পারব।

ঢাকা পোস্ট : গবেষণায় টিকার কার্যকারিতা ও অ্যান্টিবডি তৈরির প্রবণতা কেমন পেয়েছেন?

ডা. আশরাফুল হক : টিকার মূল কাজ হলো অ্যান্টিবডি তৈরি করা। গবেষণার অংশ হিসেবে কোভিশিল্ডের টিকা দেওয়া আমি যতজনকে পেয়েছি, তাদের শতভাগের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। কিন্তু কার্যকারিতা দেখার জন্য যে যান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন সেটি বাংলাদেশে নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে থেকে টিকার কার্যকারিতা দেখার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং টিকা কতটুকু কার্যকর হয়েছে সেটি বলার সুযোগ নেই। কিন্তু কত শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে সেটি যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে বলা যায় যে প্রায় সব মানুষের শরীরেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে সেটি কোমরবিডিটি কন্ডিশন ছাড়া বাকিদের ক্ষেত্রে ধরে রাখার প্রবণতা খুবই ভালো। আশা করা যায়, এটি আরও দীর্ঘমেয়াদি সময় পর্যন্ত তাদের সুরক্ষা দেবে।

যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে তাদের ক্ষেত্রে টিকা পছন্দ করে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই— বলছেন ডা. আশরাফুল হক

ঢাকা পোস্ট : দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষই মডার্না-ফাইজারের টিকা নিতে চাচ্ছেন। তাদের জন্য আপনার বক্তব্য কী?

ডা. আশরাফুল হক : আমি বলেছি, যাদের কোনো কোমরবিড কন্ডিশন নেই, আর যাদের বয়স ৫০ বছরের নিচে তাদের ক্ষেত্রে টিকা পছন্দ করে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাইরের দেশগুলোতেও টিকা পছন্দ করে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশেও এ সুযোগ দেওয়া উচিত নয় এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এ সুযোগ নেওয়াও উচিত নয়। কারণ, যে টিকাগুলো বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে, তার সবগুলোই কার্যকর। আমরা সিনোফার্ম টিকার যে কার্যকারিতা আর অ্যান্টিবডি তৈরির প্রবণতা দেখছি, সেটি আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য বেশ ভালো হিসেবে পাচ্ছি। সুতরাং ‘আমি এ ভ্যাকসিন নেব’, ‘ওটা নেব না’—এমনটি করার সুযোগ নেই। আমাদের যদি কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকে তাহলে পছন্দমতো টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

আমাদের উচিত যারা বয়স্ক এবং যাদের কোমরবিডি কন্ডিশন রয়েছে তাদের এমআরএনএ টিকাগুলো নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

আমাদের টিকা নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা নামে যে ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে, সেটি কিন্তু প্রতিটি কেন্দ্র থেকে আলাদাভাবে অপারেট করা যায়। এক্ষেত্রে কে কোন টিকা পাবে, এটি কিন্তু কেন্দ্র থেকেই সুনির্দিষ্ট করে নেওয়া সম্ভব। কারণ, সেখানে বয়সের তালিকা দেওয়া থাকে। সুতরাং টিকার এসএমএস দেওয়ার সময় বিষয়টিকে ক্যাটাগরাইজ করে নিতে হবে। সবমিলিয়ে সবার সহযোগিতার মাধ্যমেই কিন্তু সমাধান করতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : কোমরবিডিটি বা বয়সের ভিত্তিতে সুরক্ষা ওয়েবসাইটে আলাদা কোনো ক্যাটাগরি যুক্ত করে টিকা নির্ধারণ করে দেওয়া যায় কি না?

ডা. আশরাফুল হক : আসলে আমরা যখন টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশন করি, তখন কিন্তু কোনো ভ্যাকসিন পছন্দ করার সুযোগ থাকে না। আমরা শুধু সেখানে রেজিস্ট্রেশনই করতে পারি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে আমরা টিকা পছন্দ-অপছন্দ করি। এক্ষেত্রে কোনো ক্যাটাগরি যুক্ত না করে আমরা কেন্দ্র থেকেই এসএমএস দেওয়ার সময় বিষয়টি অপারেট করতে পারি। সুতরাং ভিন্ন কোনো উপায় অবলম্বন না করে যদি আমরা কেন্দ্রকে সহযোগিতা করি, তাহলেই এমনটি করার কোনো সুযোগ থাকে না।

ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফুল হক / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : শিশুদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন টিকা তাদের জন্য বেশি কার্যকর ও নিরাপদ বলে আপনি মনে করেন?

ডা. আশরাফুল হক : শিক্ষার্থীদের টিকার ব্যাপারটি আসলে গবেষণার বিষয়। তাদের নিয়ে আমরা এখন পর্যন্ত যে গবেষণাগুলো দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো সব বাইরের দেশে। সুতরাং আমাদের দেশে যে জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করা হয়েছে, তাদের পুষ্টিগত অবস্থা কিন্তু বাইরের দেশের তুলনায় একটু ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভ্যাকসিনের মূল কাজ হচ্ছে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা। প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত। তাই আমাদের দেশে শুরুতে স্বল্প পরিসরে টিকা না দিয়ে যদি গণহারে দেওয়ার পরিকল্পনা করি, তাহলে হয়তো আমাদের হোঁচট খাওয়া লাগতে পারে। কারণ, ঢাকার বাচ্চাদের শারীরিক ক্ষমতা গ্রাম অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা হলেও ভিন্ন। সুতরাং আমরা যদি গ্রামাঞ্চলে বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করি, বিশেষ করে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তাহলে আমাদের সুপরিকল্পিতভাবে টিকা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ, একটি দুর্ঘটনা পুরো টিকার কার্যক্রমকে থামিয়ে দিতে পারে।

টিআই/এসকেডি/এমএআর/