টানা ২০ বছর যুদ্ধের পর সামরিক শক্তির জোরেই গত বছরের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে নিয়েছিল তালেবান। সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি সোমবার (১৫ আগস্ট) তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের প্রথম বার্ষিকী পালন করছে।

ক্ষমতায় ফিরে আসার প্রথম বর্ষপূর্তি পালনে সোমবার দেশটিতে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করেছে তালেবান। সোমবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় দফায় তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর সামগ্রীকভাবে একটি অশান্ত বছর পার করেছে আফগানিস্তান। এই সময়ের মধ্যে দেশটিতে নারী অধিকার চূর্ণ হয়েছে এবং দেশটিতে বিদ্যমান মানবিক সংকট আরও খারাপ হয়েছে।

তালেবানের অগ্রাভিযানের মুখে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকারের পতন হয়। দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি সেদিনই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কাবুলে প্রবেশ করে গোষ্ঠীটির যোদ্ধারা।

এরপর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে তালেবান। তবে বিশ্বের কোনো দেশই এখনও অবশ্য তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এছাড়া ক্ষমতা দখলের পর তাদের উচ্চারিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিও রয়েছে অধরাই।

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর গত বছরের ১৫ আগস্ট তালেবানের যোদ্ধা হিসেবে কাবুলে প্রবেশ করেছিলেন নিয়ামতুল্লাহ হেকমত। কাবুল আক্রমণ এবং দখলের এক বছর পর এখন তিনি বলছেন, ‘আমরা জিহাদের বাধ্যবাধকতা পূরণ করেছি এবং আমাদের দেশকে স্বাধীন করেছি।’

এএফপি বলছে, ক্ষমতাসীন তালেবান কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত তাদের বার্ষিকী উপলক্ষে কোনো আনুষ্ঠানিক উদযাপন ঘোষণা করেনি। তবে আফগান রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলেছে, বছরপূর্তি উপলক্ষে তারা বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।

তালেবান যোদ্ধারা অবশ্য আনন্দ প্রকাশ করেছে যে তাদের দল এখন ক্ষমতায় রয়েছে। সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, আফগানিস্তানের ৩৮ মিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছে।

হেকমত বলছেন, যে সময় আমরা কাবুলে প্রবেশ করি এবং আমেরিকানরা যখন চলে যায়, সেই সময়টি ছিল আনন্দের মুহূর্ত। গত বছর বিজয়ীর বেশে কাবুলে প্রবেশ করা এই যোদ্ধা বর্তমানে আফগান বিশেষ বাহিনীর সদস্য এবং তিনি এখন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ পাহারার দায়িত্বপালন করছেন।

কিন্তু সাধারণ আফগান নাগরিক বিশেষ করে নারীদের জন্য তালেবানদের প্রত্যাবর্তন শুধু কষ্টই বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর প্রাথমিকভাবে কঠোর ইসলামি শাসনের পরিবর্তে একটি উদার শাসন কাঠামোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালেবান।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি মেনে চলার জন্য নারীদের ওপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আফগানিস্তানের কয়েক হাজার মেয়েকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বাইরে রাখা হয়েছে, একইসঙ্গে নারীদেরকে অনেক সরকারি চাকরিতে ফিরে আসতে বাধা দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া চলতি বছরের মে মাসে সর্বজনীন ভাবে আফগান নারীদের বোরকা পরার নির্দেশ দেওয়া হয়। কাবুলের বাসিন্দা ওগাই আমাইল বলছেন, ‘যেদিন থেকে তারা (তালেবান ক্ষমতায়) এসেছে, জীবন তার অর্থ হারিয়েছে।

আফগান এই নারীর অভিযোগ, ‘আমাদের কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তারা এমনকি আমাদের ব্যক্তিগত জায়গায় প্রবেশ করেছে।’

এর আগে গত শনিবার রাজধানী কাবুলে কয়েক ডজন নারীর বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করে দেয় তালেবান। এ সময় নারীদের বেধড়ক লাঠিপেটার পাশাপাশি ফাঁকা গুলিও বর্ষণ করে তালেবানের যোদ্ধারা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, প্রায় ৪০ জন নারী তাদের অধিকারের দাবিতে আফগানিস্তানের রাজধানীতে মিছিল করছিলেন। পরে তালেবানের সদস্যরা লাঠিচার্জ এবং শূন্যে গুলি ছুড়ে সেই মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তালেবানের যোদ্ধারা বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নারীদের মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয় বলে অভিযোগ করেছেন বিক্ষোভকারীরা।

সংবাদমাধ্যম বলছে, গত বছরের আগস্টের মাঝামাঝিতে ক্ষমতা দখলে নেওয়ার পর থেকে আফগানিস্তানের নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের পর তা আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। এছাড়া পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীদের একাকী ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোও বন্ধ রয়েছে।

অবশ্য তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে আফগানরা তাদের দেশে সহিংসতা হ্রাস পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও মানবিক সংকট অনেককে আরও অসহায় করে দিয়েছে। কান্দাহার শহরের দোকানদার নুর মোহাম্মদ বলছেন, ‘আমাদের দোকানে আসা লোকেরা এতো বেশি দামের অভিযোগ করছে যে আমরা দোকানদাররা নিজেদের ঘৃণা করতে শুরু করেছি।’

তবে তালেবান যোদ্ধাদের জন্য বিজয়ের আনন্দ বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। কাবুলের একটি পাবলিক পার্ক পাহারারত একজন যোদ্ধা বলছেন, ‘আমরা দরিদ্র হতে পারি, আমরা হয়তো কষ্টের সম্মুখীন হতে পারি, কিন্তু ইসলামের সাদা পতাকা এখন আফগানিস্তানে চিরকালের জন্য উড়বে।’

উল্লেখ্য, ২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালেবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালেবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়।

অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এর জেরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ও এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থাও আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট প্রতিদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই বিদেশি সহায়তার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল আফগানিস্তানের অর্থনীতি। গত বছরের আগস্ট থেকে সেই সহায়তা আসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত এক বছরে আর্থিক ও মানবিক সংকট কেবলই বেড়েছে।

টিএম