ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসন অলংকৃত করে রেখেছিলেন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। মাস কয়েক আগেই তার সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর উদযাপন করা হয়েছিল। ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক ঘটে। অভিষেক অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৯৫৩ সালে। সেদিনও উৎসবে মেতে উঠেছিল মানুষ। 

দিনটি ছিল ১৯৫৩ সালের ২ জুন। সবার দৃষ্টি লন্ডনের দিকে। খুশিতে, আনন্দে, উত্তেজনায় কাঁপছে শহর। শুধু লন্ডন নয়, পুরো কমনওয়েলথ জুড়েই সবার দৃষ্টি তখন রানির অভিষেক অনুষ্ঠানের দিকে। জুনের সেই সকালে আবহাওয়া ছিল কিছুটা শীতল, সকালের বৃষ্টি শেষে আকাশে সূর্য দেখা যেতে পারে এমন আশাও দেখা যাচ্ছিল।

অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে জন্য রানি বের হবেন তার লন্ডনের ঠিকানা বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে। সেখান থেকে তিনি যাবেন ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে, যেখানে মুকুট পরানোর মাধ্যমে তার অভিষেক সম্পন্ন হবে। সেদিন শহরজুড়ে সব ভবন ঢাকা পড়ে  গিয়েছিল অভিষেক উৎসবের সাজে, কেবল বাকিংহাম প্রাসাদের পূর্বদিকের সম্মুখভাগটাই যেন বাদ পড়েছিল।

 সোনায় মোড়ানো শকটে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অভিষেক অনুষ্ঠানে

রানি যখন বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যান, তখন সহচরী হিসেবে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছিল ছয় তরুণীকে। তাদের দায়িত্ব ছিল রানির দীর্ঘ পরিচ্ছদের ভেলভেটের শেষ প্রান্তভাগ ধরে রাখা, আর সেই সঙ্গে নিজেদেরও সুন্দর সাজে ফুটিয়ে তোলা।

রানি এলিজাবেথের বয়স তখন ২৬। তিনি আবদার করেছিলেন যে, তার অভিষেক অনুষ্ঠানটি যেন সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হয়। রাজপরিবারের এ অনুষ্ঠানটির কিছু কিছু ঐতিহ্য বহু শতকের, ৯০০ বছর আগে থেকে চলছে। কিন্তু সেবার অনুষ্ঠানটি যত মানুষ দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তেমনটি এর আগে কখনো ঘটেনি।

 শিশু কন্যা অ্যানকে কোলে নিয়ে রানি এলিজাবেথ। ১৯৫১ সালের ছবি

বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে থেকে সেদিনের উৎসবমুখর লন্ডনের পরিবেশ বর্ণনা করছিলেন টেলিভিশন ধারাভাষ্যকার। শুধু প্রাসাদের সামনে নয়, যে পথ ধরে রানি যাবেন, তার দুপাশেই ছিল উৎসাহী মানুষের ভিড়। সেই পথের নানা জায়গায় মোতায়েন ছিলেন আরও কয়েকজন ধারাভাষ্যকার। সাত ঘণ্টা ধরে সেদিনের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখানো হয়েছিল টেলিভিশনে।

রানির শোভাযাত্রা দেখতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তার দুপাশে লাইনে দাঁড়িয়ে। অনেকে রাতে বৃষ্টির মধ্যে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র আট বছর আগে, যুদ্ধের পর ধুসর লন্ডন নগরী সেই প্রথম যেন কোনো উৎসবের জন্য নানা রঙে সেজে উঠেছে।

বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রানির শোভাযাত্রা চলেছে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির দিকে

সোনায় মোড়ানো যে শকটে করে রানি যাবেন, সেটির অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছে মানুষ। অ্যাডমিরালটি আর্চের নীচ দিয়ে যখন রানির শকট এগিয়ে এলো, হর্ষ-ধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানাল মানুষ।

আড়াইশ জনের বিশাল এক শোভাযাত্রা শুরু হলো ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির দিকে। রানির পাশে ডিউক অব এডিনবারা। ভেতরে তখন সারা বিশ্ব থেকে আসা আট হাজার অতিথি। রানির যখন শপথ শেষে অভিষেক অনুষ্ঠানের সেই মুহূর্তটি, যেটি টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখানো নিষেধ। রানিকে এরপর পবিত্র তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করা হবে। রানির পরনের পোশাক খুলে ফেলা হয়। খুলে নেওয়া হয় সব অলংকার। তাকে পরানো হয় একেবারেই একটি সাদা রঙের সাদামাটা পোশাক।

সেদিন লন্ডনের রাস্তায় রানিকে এক নজর দেখার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল

এরপর ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবির ডিন পবিত্র তেলের একটি পাত্র নিয়ে আসলেন আর্চবিশপের কাছে। এরপর আর্চবিশপ রানিকে তেল মাখিয়ে অভিষিক্ত করার জন্য চলে গেলেন সামিয়ানার নীচে সবার আড়ালে। অভিষেক শেষে রানিকে নিয়ে রাজকীয় বহর এরপর আবার লন্ডনের রাস্তা ধরে ফিরে চলল। যখন তার গাড়ি আবার বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরে এল, সেখান থেকেও সরাসরি টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল সেই দৃশ্য। রানিকে তার শকট থেকে নামতে সাহায্য করলেন চারজন সহচরী।

 তবে প্রাসাদে ফেরার পর রানিকে তার পারিবারিক কাজেই আবার বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছিল। তিনি ফিরে গেলেন তার ছোট্ট দুই ছেলে মেয়ে চার্লস আর অ্যানের কাছে। সেদিন যা যা ঘটেছিল, সেগুলোর একটি ভিডিও চিত্র তৈরি করা হয়েছিল রানির জন্য।

বিবিসি অবলম্বনে

আরএইচ