ছবি: আলজাজিরা

মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের তেলসমৃদ্ধ দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নিবন্ধ লেখায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেখানকার প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকা আল রোয়েয়া। সেই সঙ্গে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে অধিকাংশ সংবাদকর্মীকে।

গত ২১ জুন চুড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পত্রিকাটি। সেই সঙ্গে চাকিরচ্যুত করা হয়েছে প্রায় ৫০ জন সংবাদকর্মীকে, তাদের মধ্যে একদিনেই ছাঁটাই নোটিশ পেয়েছেন অন্তত ৩৫ জন সংবাদকর্মী।

পত্রিকাটির মালিকপক্ষ চাকরিচ্যুত সংবাদকর্মীদের এ ব্যাপারে মুখ না খুলতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছিল। এ কারণে এতদিন পর্যন্ত জনসমক্ষে আসেনি এ ঘটনা।

সম্প্রতি আল রোয়েয়ার কয়েকজন চাকরিচ্যুত কর্মী মার্কিন বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এবং বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষণকারী ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখনই ব্যাপারটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে।

এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আল রোয়েয়ার আট জন চাকরিচ্যুত কর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এপি। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে মার্কিন এই সংবাদ সংস্থা। সরকার প্রতিশোধমূলক নীতি নিতে পারে— এই ভয়ে তথ্য প্রদানকারী সব কর্মীই তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন এপিকে।

টানা দুই বছরের করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্বজুড়ে বাড়ছিল জ্বালানি তেলের দাম। এই পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ বিভিন্ন দেশ জ্বালানি তেলে ভর্তুকির হার বাড়ালেও আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক মুনাফার আশায় আমিরাত তেলের ওপর ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নেয়।

ফলে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের চেয়ে আমিরাতে তেলের মূল্য ছিল বেশি। এই দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় চলতি বছর গ্রীষ্মে, মে-জুন মাসের দিকে। তেলের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে আমিরাতের সাধারণ জনগণ ব্যাপক ভোগান্তির মধ্যে পড়েন।

এমন এক পরিস্থিতে গত ০২ জুন একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে আল রোয়েয়া। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আমিরাতের জনভোগান্তিই ছিল সেই নিবন্ধের মূল বিষয়বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই ভোগান্তির শিকার বহু মানুষের বক্তব্য-মন্তব্য সংযুক্ত করা হয়েছিল নিবন্ধটিতে।

সাক্ষাৎকার দেওয়া এসব লোকজনের মধ্যে কয়েকজন ট্যাক্সিচালকও ছিলেন। তারা আল রোয়েয়াকে জানিয়েছিলেন, দেশে দাম চড়া থাকায় তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ওমানে গিয়ে পেট্রোল কেনেন। আমিরাতের তুলনায় ওমানে পেট্রোলের দাম অর্ধেক।

নিবন্ধটি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটি আল রোয়েয়ার ওয়েবাসাইট থেকে মুছে ফেলা এবং সেটি যেন কোনোভাবেই প্রিন্টেড কপি আকারে না আসে, সে ব্যবস্থা নিতে আল রোয়েয়া সম্পকাদককে নির্দেশ দেয় আইএমআই কর্তৃপক্ষ।

মালিক প্রতিষ্ঠানের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন আল রোয়েয়ার সংবাদকর্মীরা। চাকরিচ্যুত এক জেষ্ঠ্য সংবাদকর্মী এপিকে বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতে গণমাধ্যম আইন কঠোর; কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম, যেহেতু আল রোয়েয়ার মালিক প্রেসিডেন্টের আপন ছোটো ভাই, এই নিবন্ধটি প্রকাশ করলে সমস্যা হবে না। আমাদের ধারণা ভুল ছিল।’

আরবি ‘আল রোয়েয়া’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘দৃষ্টি’। রাজধানী আবুধাবিভিত্তিক বিনিয়োগ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ইনভেস্টমেন্ট (আইএমআই) ২০১২ সালে জাতীয় এই দৈনিকটি বাজারে আনে। এই আইএমআইয়ের স্বত্ত্বাধিকারী হলেন শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।

আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মেদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের ছোটোভাই শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম। আমিরাত ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আর্থিক বিনিয়োগ রয়েছে তার। আরবি দৈনিক আল রোয়েয়া ছাড়াও আমিরাতভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক দ্য ন্যাশনাল নামে একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রকাশক আইএমআই। এছাড়া যুক্তরাজ্যভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল স্কাই নিউজের আরবি সংস্করণ স্কাই নিউজ অ্যারাবিয়ারও মালিক প্রতিষ্ঠানেরও মালিক প্রতিষ্ঠান আইএমআই। একাধিক সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি ব্রিটিশ ফুটবল ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিরও মালিক শেখ মনসুর।

নিবন্ধটি প্রকাশের এক সপ্তাহ পর আইএমআই শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নার্ত বৌরান আল রোয়েয়া কার্যালয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি ঘোষণা দেন, এখন থেকে আল রোয়েয়া নামে আর কোনো সংবাদমাধ্যম থাকবে না এবং খুব শিগগিরই সিএনএনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নতুন একটি আরবি সংবাদমাধ্যম খুলতে যাচ্ছে আইএমআই।

ওই দিনই নিবন্ধটি লেখা ও প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মীদেরসহ অন্তত ৩৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তার পরের কয়েকদিনে ছাঁটাই করা হয় আরও ১৫ জনকে।

নার্ত বৌরানের বৈঠকের পরই পত্রিকাটির প্রিন্টেড সংস্করণ প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপর ২১ জুন বন্ধ করে দেওয়া হয় আল রোয়েয়ার অনলাইন সাইটটিও।

এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, চাকরিচ্যুত প্রত্যেক কর্মীকেই আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে তাদের সামনে দু’টি বিকল্প হাজির করেছে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ইনভেস্টমেন্ট কর্তৃপক্ষ— হয় বেতন ও অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করে পদত্যাগপত্র জমা দিতে হবে অথবা চাকরিচ্যুত হয়ে আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখী হতে হবে। বলা বাহুল্য কর্মীদের সবাই প্রথম বিকল্পটিই গ্রহণ করেছেন।

এ সম্পর্কে মন্তব্য জানতে আইএমআই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এপি। প্রতিষ্ঠানটির এক জেষ্ঠ্য কর্মকর্তা এপিকে বলেন, ‘আল রোয়েয়া বন্ধের সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যজনক হলেও প্রয়োজনীয় ছিল।’

 সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পর্যবেক্ষনকারী ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য বিভাগের গবেষক ও বিশ্লেষক ক্যাথরিন গ্রোথে এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এপিকে বলেন, ‘আল রোয়েয়ার এই ঘটনাটি আসলে একটি দমনমূলক সমাজের আদর্শ উদাহারণ। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে উদারতা ও খোলামেলা মনোভাবের ভান করলেও ভেতরে ভেতরে যে চরম দমনমূলক নীতি মেনে চলে, তার সর্বশেষ নজির এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়া। দেশটির সংবাদমাধ্যম ক্ষেত্রে এই ঘটনার গভীর প্রভাব পড়বে।’

এসএমডব্লিউ