ছবি: এনডিটিভি

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের একটি অডিও টেপ নিলামে তুলেছে ওয়েব কন্টেন্টের কালোবাজার হিসেবে পরিচিত ডার্ক ওয়েব; এবং নিলামে সেই অডিও টেপের ন্যূনতম দাম হাঁকা হয়েছে সাড়ে তিন লাখ ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।

পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দল তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) জেষ্ঠ্য নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী সোমবার দেশটির সংবাদমাধ্যম এআরওয়াই নিউজকে এ তথ্য জানিয়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অসতর্কতা ও গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার ফলেই ফাঁস হয়েছে ১১৫ ঘণ্টার এই অডিও টেপটি।

কিন্তু কী আছে সেই অডিও টেপে? এআরওয়াই নিউজের বরাতে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব, পাকিস্তান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের স্পিকার আয়াজ সাদিক, প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ, আইনমন্ত্রী আজম তারার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লার কণ্ঠ ও বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে সেই টেপটিতে।

পাকিস্তানের দৈনিক ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম ক্লিপটিতে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী মিফতাহ ইসমাইল সম্পর্কে আলোচনা ও পরামর্শ করতে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ও ও তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেবকে। দেশের অর্থনীতি সংস্কারে বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াই ইতোমধ্যে নিজের পার্টি পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজে (পিএমএল-এন) বর্তমানে কোনঠাসা অবস্থায় আছেন মিফতাহ। শেহবাজ শরিফ ও মরিয়ম আওরঙ্গজেব পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আছেন।

অডিও ক্লিপে মরিয়মকে বলতে শোনা গেছে— পেট্রোল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর যে ঘোষণা সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন, তার সঙ্গে তিনি একেবারেই একমত নন। এই প্রশ্নে এমনকি তার দল পিএমএল-এন ক্ষমতায় থাকল কি থাকল না— তাও গুরুত্বপূর্ণ নয় মরিয়মের কাছে। মিফতার নীতির নিন্দাও করতেও শোনা গেছে মরিয়মকে।

এ ছাড়াও ওই অডিয়ো ক্লিপে এমন আরও অনেক টুকরো টাকরা কথোপকথন ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে।

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ অবশ্য ওই ক্লিপকে বেশি গুরুত্ব দিতে চাননি। ডনকে তিনি  বলেছেন, অডিয়ো রেকর্ডিংয়ে এমন কিছু নেই, যাতে আতঙ্কিত হতে হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে নীরবতার কারণে এসব অডিও টেপ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠছে, যার মূল বিষয় হচ্ছে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের সাইবার নিরাপত্তা।

অতীতেও পাকিস্তানে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছে, তবে এগুলোর বেশিরভাগই ছিল ফোন কথোপকথন।

ফাঁস হওয়া অডিও টেপে পিটিআইয়ের পদত্যাগের বিষয়েও কথা বলতে শোনা গেছে পিএমএল-এনের জ্যেষ্ঠ নেতাদের।

পিটিআই নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী ওই অডিও শেয়ার করে প্রশ্ন তুলেছেন, ডার্ক ওয়েবে যেভাবে প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের অফিসের তথ্য বিক্রির জন্য পেশ করা হয়েছে, এরমধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের সাইবার নিরাপত্তার পরিস্থিতি কী তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। এটা আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, বিশেষ করে আইবির বড় ব্যর্থতা। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও নিরাপত্তা ও বিদেশ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এখন সবার হাতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রশ্ন করা হচ্ছে কখন, কীভাবে এবং কোথায় এটা রেকর্ড করা হয়েছিল? বেশিরভাগ মানুষই জানতে চাচ্ছেন যে এটি আসলেই নিরাপত্তার ত্রুটি কিনা এবং যদি তাই হয়, তাহলে এই নিরাপত্তা ত্রুটি কতটা বড় এবং এর জন্য কে দায়ী?

খাইবার পাখতুনখোয়ার অর্থমন্ত্রী তৈমুর ঝাগদাও একই রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শওকত তারিনের সঙ্গে তার একটি কথোপকথেনর অডিও কিছুদিন আগে ফাঁস হয়েছিল।

শওকত তারিন প্রশ্ন করেন, কোন আইনের আওতায় এবং কখন, কে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথোপকথনটি ট্যাপ করছে, পিএমওতে বা ফোনে, কেউ কি উত্তর দেবে? এবং এই তথ্য রক্ষার দায়িত্ব কার?

পাঞ্জাবের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী ড. আরসালান খালিদ বলেছেন, আসল প্রশ্ন হলো, ১০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে রেকর্ডিং কীভাবে হলো? প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে কি গোয়েন্দা যন্ত্র বসানো হয়েছিল?

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘরে পররাষ্ট্রনীতিসহ সব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে কি এই সব তথ্যও হ্যাকারদের কাছে আছে? এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা পাকিস্তানের ওপর সাইবার হামলা।

উমর সাইফ, যিনি পূর্ববর্তী শেহবাজ শরিফ সরকারের সময় পাঞ্জাবে ডিজিটাল সংস্কার বাস্তবায়ন করেছিলেন, তিনি বলছেন যে, পাকিস্তানের সাইবার স্পেস নিরাপদ নয়।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাইবারস্পেসের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই। তিনি বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। পাকিস্তানকে রাজনৈতিক উত্তেজনার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে এবং বুঝতে হবে হুমকি আসলে কী।

একজন সিনিয়র সাংবাদিক বলেন, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কি কথোপকথনটি রেকর্ড করেছে, নাকি তারা এ বিষয়ে অবগত ছিল না?

সাংবাদিক আসিমা শিরাজি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনও যখন নিরাপদ নয়, তখন বাকিদের কী বলার আছে। জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ সালের উপন্যাসের চরিত্র ‘বিগ ব্রাদার’-এর কথা মনে পড়ে গেল, যে সব কিছুর ওপর নজর রাখে। এখানে বড় ভাই কে? 

সাংবাদিক মুবাশির জাইদি লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও মরিয়ম নওয়াজের উচিত অডিও ফাঁসের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানানো। যদি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটে, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ারম্যান এতদিনে পদত্যাগ করতেন।

 এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা না আসায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, এই অডিও যদি ভুয়া না হয়, তাহলে এটা রেকর্ড করা হলো কিভাবে? 

আজিজ ইউনুস নামে একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী লিখেছেন, প্রথম পরিস্থিতি হলো, সেখানে উপস্থিত কারও ফোন হ্যাক করা হয়েছে, যেখানে লোকেশনের সাহায্যে ফোনের মালিকের সম্মতি ছাড়াই ফোনে থাকা হট মাইক ব্যবহার করা হয়েছে।

 আজিজ ইউনূসের মতে, এমনও হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে থাকা গোয়েন্দা যন্ত্রের সাহায্যে এই কথোপকথনটি রেকর্ড করা হয়েছিল এবং পরে তা ফাঁস করা হয়।

সাংবাদিক সিরিল আলমাইদা লিখেছেন, ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমি প্রথম একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম যে, একজন লোক এসে মেশিনের সাহায্যে দু’বার ঘরে তল্লাশি চালায় এবং সমস্ত ডিজিটাল গ্যাজেট দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

এসএমডব্লিউ