পানির ওপর চীনের একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র

চীন নিজের ১৪তম পাঁচসালা পরিকল্পনা তুলে ধরতে যাচ্ছে শুক্রবার। এটিই হবে আগামী কয়েক বছরের জন্য তাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ গতিধারার রোডম্যাপ। মনে করা হচ্ছে- এখানে হয়তো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাকে একটি অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করবে বেইজিং।

চীন যে কেবল অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি তাই নয়- দেশটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী। তাই মনে করা হয়, কার্বন নির্গমন কমিয়ে আনার জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপের রূপরেখা থাকবে সেই পরিকল্পনায়। কিন্তু এ নিয়ে একটা উদ্বেগও আছে। সেটা হলো- কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে গেলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতির ওপর। তাই খুব বেশি ‘সবুজ’ অর্থনীতির দিকে চীনের এগিয়ে যাওয়ার পথে সেটা একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

পাঁচসালা পরিকল্পনাটা কি?

১৯৫৩ সাল থেকে চীন এরকম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রকাশ করে আসছে। এটি হচ্ছে একটি পরিকল্পনার দলিল- যাতে আগামী পাঁচ বছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন আর পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। মূলত: এটি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি।

এই পরিকল্পনায় যে কাঠামো তুলে ধরা হয়- সেটিই সরকার ও শিল্পখাতের সকল নীতিগত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। দশকের পর দশক ধরে এই পরিকল্পনা চীনের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছে। এর ফলে চীনের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান।

এ পরিকল্পনার গুরুত্ব কোথায়?
কার্বন নির্গমনের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, গোটা পৃথিবীই হুমকির মুখে পড়ছে। তাই চীনের জন্য মূল প্রশ্নটা হলো, তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ঘটাতে হবে, অন্যদিকে কার্বন নির্গমনও সীমিত করতে হবে। এ দুটো একসঙ্গে কীভাবে সম্ভব?

গত সেপ্টেম্বর মাসে এক ঘোষণা দিয়ে সারা পৃথিবীকে চমকে দেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি ঘোষণা করেন- তার দেশ ২০৬০ সাল নাগাদ নেট কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনবে এবং ২০৩০ সালের আগেই তাদের কার্বন-ব্যবহারকে শীর্ষবিন্দুতে নিয়ে যাবে।

নেট কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনার অর্থ হচ্ছে- গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা এবং এর পরের অতিরিক্ত নির্গমনগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে বায়ুমণ্ডল থেকে সমানুপাতিক পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণ করা। নতুন এই পাঁচসালা পরিকল্পনা হচ্ছে সেটা অর্জনের পথে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তা ছাড়া এই লক্ষ্যগুলো কতটা বাস্তবসম্মত- তারও একটা ধারণা এ থেকে বিশ্লেষকরা পাবেন।

আগামী পাঁচ বছরের পদক্ষেপগুলোর রূপরেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও করছে। এর অংশ হিসেবে আছে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা।

চায়না ডায়ালগ সাময়িকীর প্রতিষ্ঠাতা এবং সিনিয়র উপদেষ্টা ইসোবেল হিলটন বলছেন, ‘চীন ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগুলোকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। এতে আছে লো-কার্বন প্রযুক্তি। তারা অর্থনীতিকে বাজারের উচ্চ স্তরের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে, চেষ্টা করছে একটা ভিত্তি স্থাপনের - যাতে চীন নিম্নমাত্রায়-কার্বন-নির্গত-করে এমন পণ্য এবং প্রযুক্তির সরবরাহকারী হয়ে উঠতে পারে।’

নতুন পরিকল্পনায় কী থাকবে?

এখানে থাকবে কিছু মৌলিক লক্ষমাত্রা- যা বিশ্লেষকরা পরিকল্পনাটি কতটা উচ্চাভিলাষী তার বিচার করতে ব্যবহার করবেন। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে- সমগ্র অর্থনীতি জুড়ে প্রবৃদ্ধির সংখ্যাসমূহ, কিন্তু এর সঙ্গে আরও থাকবে জিডিপির প্রতি ইউনিটে কি পরিমাণ কার্বন ব্যবহৃত হচ্ছে।

সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এ্যান্ড ক্লিন এয়ার নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বিশ্লেষক লরি মিলিভির্তা বলছেন, ‘চীনের যেসব প্রদেশ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কয়লার ওপর নির্ভরশীল - তাদেরকে তাদের অর্থনীতি ও ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনা এবং ফসিলজাত জ্বালানিক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করাতে হবে। এই দুই লক্ষ্য অর্জনে একটা ভিত্তি স্থাপন করা আগামী পাঁচ বছরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

অন্য আরেকটি পূর্বশর্ত হচ্ছে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির জন্য একটা যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা - যাতে এই সেক্টরটি এ দশকের শেষ দিকের প্রয়োজন মেটানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।

কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দু
চীন বলছে, ২০৩০ সালের আগেই তাদের কার্বন নির্গমন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাবে - অর্থাৎ তারপর থেকেই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, নতুন পাঁচসালা পরিকল্পনায় এমন কিছু লক্ষ্য থাকবে যাতে চীন নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই সেই শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যেতে পারে। তবে এসব লক্ষ্য হয়তো এই পরিকল্পনার দলিলে ধাকবে না, এমন সম্ভাবনাও আছে।

সাধারণত জলবায়ু ইস্যুতে কম প্রতিশ্রুতি দিয়ে, বেশি অর্জন করতেই দেখা যায় চীনকে। লরি মিলিভির্তা বলছেন, ‘ফসিলজাত নয় এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা এমন হতে পারে যে- কার্বন নির্গমন বছরে এক শতাংশ করে বাড়তে পারে। তবে যদি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী হয় এবং সার্বিকভাবে জ্বালানির চাহিদার প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশার চাইতে কম হয় - তাহলে হয়তো ২০২৫ সালের আগেই চীনের নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাবে।’

অন্য অনেকে অবশ্য এমন সম্ভাবনার কথা আরও বেশি জোর দিয়েই বলছেন। গ্রিনপিস ইস্ট এশিয়ার লি শুও বলছেন, ‘আমাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী চীন নিশ্চয়ই ২০২৫ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছাবে। চীনের জন্য এখনও তাদের কার্বন নির্গমনের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানোর সময়সূচি ২০২৫ সালের আগে নিয়ে আসার ভালো সম্ভাবনা আছে বলে আমরা মনে করি। চীনের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষকদের বেশিরভাগই এই মতের সমর্থক বলেও আমাদের ধারণা।’

যদি সেটা হয়, তাহলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রাকে এই শতাব্দীতে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রয়াসে এটা হবে বড় উৎসাহব্যঞ্জক অর্জন। কারণ, ১.৫ ডিগ্রি এবং ২ ডিগ্রিকে দীর্ঘদিন ধরেই ‘বিপদজ্জনক’ স্তরের বৈশ্বিক উষ্ণায়নের দ্বার বলে মনে করা হচ্ছে।

কয়লার ভূমিকা
চীনে কয়লার ব্যবহার ভবিষ্যতে কী পরিমাণ হবে - তা সারা বিশ্বের জন্যই একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সারা পৃথিবীতে যে পরিমাণ কয়লা উৎপাদিত হয় তার অর্ধেকই ব্যবহৃত হয় চীনে। পৃথিবীতে ২০২০ সালে যতগুলো কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে- তার তিন চতুর্থাংশই ছিল চীনে।

এখন চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র নেতারা চাইছেন দেশকে কয়লা-নির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের আঞ্চলিক সরকারগুলো আরো বেশি করে চাকরি সৃষ্টি করতে চায় এবং তারা আরও অনেকগুলো কয়লা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে।

লরি মিলিভির্তা বলছেন, ‘মনে হচ্ছে যে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের জন্য যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা দরকার - চীনের তা নেই। কাজেই আগামীতে খুব সম্ভবত নতুন আরও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যোগ হতে থাকবে, কিন্তু উৎপাদনে শূন্য বা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি- অর্থাৎ অব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ বাড়তে থাকবে।’

কোভিড কতটা প্রভাব ফেলেছে?

এই সপ্তাহেই প্রকাশিত কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি যেভাবে ঝিমিয়ে পড়েছিল - সেই মন্দাবস্থা থেকে দেশটি দ্রুতগতিতে ফিরে এসেছে। তার ফলে সেখানে ২০২০ সালে কার্বন নির্গমনের মোট পরিমাণও ছিল ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি।

লি শুও বলছিলেন, ‘২০২০ সালে ইস্পাত, সিমেন্ট ও অ্যালুমিনিয়ামের মত কিছু প্রধান শিল্প উৎপাদন ২০১৯ সালের স্তর ছাড়িয়ে গেছে। এটা রীতিমত বিস্ময়কর। করোনাভাইরাস মহামারি থেকে চীনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এ পর্যন্ত যতটা হয়েছে, তার মধ্যে ‘সবুজ’ বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। তাই আসন্ন পাঁচসালা পরিকল্পনাটি হবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল -সেখানে দেখার বিষয় হবে চীন কিভাবে নতুন এবং পুরোনোকে একসঙ্গে মেলাচ্ছে।’

অন্যরা বিশ্বাস করেন অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব বা ‘সবুজ’ নীতির পথে চীনের যাত্রা হয়তো - আগে যা ভাবা গিয়েছিল - তার চেয়ে ধীরগতির হবে।

ড্রাওয়েল্ড জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্রের ঝ্যাং শুয়েই বলছেন, ‘চীন হয়তো জ্বালানি ও কার্বন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যতামূলক লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিতে পারে। কিন্তু জিডিপির প্রবৃদ্ধির মাত্রার তুলনায় তা অনেক কম হবে বলেই মনে হয়।’

রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এটা খুবই সম্ভব যে নীতিনির্ধারকরা কম উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেবেন - অন্তত জ্বালানি ও কয়লা ব্যবহারের ক্ষেত্রে - এবং এর কারণ হলো জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম