পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চলমান বিতর্কে আশার আলো দেখা গেছে। জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংগঠন জানিয়েছে, এতোদিন আগ্রহ না দেখালেও চুক্তির বেশ কিছু বিষয় নিয়ে অবশেষে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে তেহরান। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই ইস্যুতে দেশটি কোনো রকম আলোচনায় অংশ নিতে চাচ্ছিল না।

বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ)  ভিয়েনায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ডিরেক্টর জেনারেল রাফায়েল গ্রোসি সাংবাদিকদের জানান, ইরান তাদেরকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ইরানের একাধিক অঞ্চলে ইউরেনিয়ামের মজুত আছে বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে আইএইএ।

গত কয়েকমাসে তা আরও বাড়ানো হয়েছে বলেও অভিযোগ সংস্থাটির। কিন্তু এরপরও আইএইএ’র কোনো কর্মকর্তাকে ইরানে ঢুকতে এবং বিতর্কিত ওই অঞ্চলগুলোতে পরিদর্শনে যেতে দেওয়া হবে না বলে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় তেহরান। তবে বৃহস্পতিবার গ্রোসি জানিয়েছেন, ইরান এ বিষয়ে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছে।

ইরানের সিদ্ধান্তের পেছনে জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের হাত আছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই সপ্তাহেই জাতিসংঘে ইরানের বিরুদ্ধে একটি নিন্দা প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা ছিল এই তিনটি দেশের। কিন্তু আপাতত তা স্থগিত করা হয়েছে। তারপরেই সুর নরম করল তেহরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা আলোচনার বিষয়ে আশাবাদী।

অবশ্য গত কিছুদিন ধরে আলোচনার রাস্তা সম্পূর্ণ বন্ধ করে পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে ছিল ইরান। তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে পরমাণু চুক্তি নিয়ে কোনোরকম আলোচনায় বসবে না বলেও দাবি করে আসছিল দেশটি। এর পাশাপাশি ইউরেনিয়ামের মজুত অনেকগুণ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইরানি পার্লামেন্ট। পাশাপাশি দেশের পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে আইএইএ’র বিশেষজ্ঞদের নজরদারিও বন্ধ করে দেয় দেশটি।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করার কথা ছিল জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের। জার্মানির বক্তব্য, ইরান যেভাবে এগোচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত আলোচনায় বসা দরকার। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ‘প্রয়োজন মনে করলে’ ইরান ৬০ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ করবে বলে ঘোষণা দেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলী হোসেইনি খামেনি।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী হোসেইনি খামেনি

তার দাবি, ‘দেশের প্রয়োজনে পরমাণু সক্ষমতা অর্জনের বিষয়ে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ কারণে আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ২০ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং যত মাত্রা প্রয়োজন হবে তত মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ পামাণবিক প্রযুক্তি বা অন্য কোনো কাজে আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা শতকরা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হতে পারে।’

আলোচনায় বসতে না চাওয়া, সর্বোচ্চ নেতার হুংকার বা পার্লামেন্টে ইউরেনিয়ামের মজুত বাড়ানোর আইন পাসের মাধ্যমে পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর চাপ সষ্টি করতে চেয়েছিল ইরান। কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণের উদ্যেগের পরই সুর নরম করল দেশটি।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পাঁচ বিশ্ব পরাশক্তির মধ্যে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘একপেশে’, ‘এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই’ অভিযোগ তুলে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পর চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলার ব্যাপারে ইরানও উদাসীন হয়ে পড়ে।

এরপর তেহরানের ওপর আবারও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি সমঝোতায় টিকে থাকলেও চুক্তি মেনে চলার ক্ষেত্রে এসব দেশের ঢিলেঢালা মনোভাব  ছিল লক্ষ্য করার মতো।

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের বিদায় এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের দায়িত্ব নেওয়ার পর পরমাণু চুক্তিতে আবারও ফেরার ব্যাপারে আগ্রহী হয় ওয়াশিংটন ও তেহরান। অবশ্য চুক্তিতে কে আগে ফিরবে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক মতবিরোধ চলছিল। এর মধ্যে আলোচনায় ইরানের সম্মতি পরমাণু চুক্তিকে আবারও সক্রিয় করতে হয়তো সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। বাকি প্রশ্নের উত্তর সময়ের হাতে।

সূত্র: আলজাজিরা, ডয়চে ভেলে

টিএম