জাতিসংঘের কপ ২৭ জলবায়ু সম্মেলনের খসড়া চুক্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার মিসরের শারম আল শেখ শহরে সম্মেলনের আয়োজকরা এই চুক্তি প্রকাশ করেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে রয়টার্স।

বিগত বিভিন্ন জলবায়ু সম্মেলনের মতো এবারও বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের শিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য তহবিল গঠনে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু হওয়া শিল্পায়নের প্রভাবে বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, প্রাক শিল্পযুগের তুলনায় গত ১৭০ বছরে বছরে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

মূলত উন্নত দেশগুলোতে অত্যাধিক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো এবং তার ফলে নিঃসৃত কার্বন ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবেই বেড়েছে এই তাপমাত্রা।

২০১৫ সালের কপ সম্মেলনে প্রথমবার বিশ্বের তাপমাত্রা হ্রাসে পদক্ষেপ নিতে ঐকমত্যে পৌঁছায় সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো। কিন্তু তারপরের বছরগুলোতে অধিকাংশ দেশই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদাসীনতা দেখিয়েছে।

কপ ২৭ সম্মেলন আয়োজন কমিটির প্রেসিডেন্ট সামেহ শৌকরি সম্মেলনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের চুক্তিতে স্বাক্ষরের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আসুন, আমরা সবাই শুক্রবার একত্র হই এবং (চুক্তিতে স্বাক্ষর করি)।

এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গত বছর গ্লাসগো শহরে কপ ২৬ সম্মেলনে যে চুড়ান্ত চুক্তিটি প্রস্তুত করা হয়েছিল, বর্তমান খসড়া চুক্তিটিও সেই গত বছরের চুক্তিরই প্রায় অনুরূপ। ওই চুক্তিতেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ূ বিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি কপ ২৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশই বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসের পক্ষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন।

বিশ্বের যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও কার্বন নিঃসরণ করে, সেসবের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র। কপ ২৭ সম্মেলনে চীনের জলবায়ু বিষয়ক দূত শিয়ে ঝেনহুয়ার সঙ্গে বিশেষ রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন জন কেরি। তাদের বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে জানা যায়নি; তবে জন কেরি বলেছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসে জাতিসংঘের লক্ষ্যের সঙ্গে চীনের কোনো দ্বিমত নেই।  

ক্ষতিপূরণের অর্থ কোথায়

ঊণবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি অর্থাৎ ১৮৫০ সালের কাছাকাছি সময়ে ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটার পর থেকে এখন পর্যন্ত শিল্পোৎপাদন ও উন্নত জীবনযাত্রার স্বার্থে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে চলছে বিশ্বের উন্নত বিভিন্ন দেশ। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বভুক্ত দেশগুলোতে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর হার উন্নত বিভিন্ন দেশের তুলনায় এখনও অনেক কম।

কিন্তু উন্নত দেশগুলোর অতিমাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কার্বন ও গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রভাবে ঝড়, অতিবর্ষণ, খরা, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে মূলত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশ। এমনকি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মালদ্বীপসহ অনেক দ্বীপরাষ্ট্র সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতেও রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে গত কয়েক বছর ধরেই উন্নত বিভিন্ন দেশের কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে আসছে ‍উন্নয়নশীল বিশ্ব। জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি জনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এই অর্থ ব্যায় করা হবে বলে জানিয়ে আসছে এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশ।

কিন্তু ‘বিপুল পরিমাণ অর্থ’ প্রদানের ভয়ে উন্নত বিশ্ব বরাবরই এই ক্ষতিপূরণ বা এ সংক্রান্ত তহবিল গঠনে প্রদানে গড়িমসি করছে। চলতি বছরের সম্মেলনেও পরিলক্ষিত হয়েছে এ ব্যাপারটি।

ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্র অ্যান্টিগা অ্যান্ড বার্বাডোজের পরিবেশমন্ত্রী মলওয়েইন জোসেফ রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের যেসব দেশের জনগণ মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, পরিবেশ দূষণ হ্রাস করতে নিত্যদিন কাজ করছে— ক্ষতিপূরণের অর্থপ্রদানে গড়িমসি করার অর্থ হলো তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।’

কপ ২৭ সম্মেলনে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের ব্যাপারটিতে গুরুত্ব কম দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক অলাভজনক থিংক ট্যাংক সংস্থা ইথ্রিজি’র গবেষক ক্যাথেরিন অ্যাবরিউও। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, এই সম্মেলনেও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার হ্রাস করাকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হলো, সেই তুলনায় অনুন্নত দেশগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারটির তেমন উল্লেখই হলো না।’

ইউরোপীয় দেশগুলোর জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের পলিসি বিভাগের প্রধান ফ্র্যান্স টিমেরম্যানস এ বিষয়ে একমত পোষণ করে রয়টার্সকে বলেন, ‘এটি একটি খসড়া চুক্তি, এখনও এটি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। আমি মনে করি, সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগে এখানে অনেক কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে।’

‘চুক্তিটি চুড়ান্ত করতে আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করব। আমরা চেষ্টা করব এমন একটি চুক্তি তৈরি করতে— যেখানে সবার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে।’

এসএমডব্লিউ