ভারতের পশ্চিমবঙ্গে স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের একাধিক দুর্নীতির মামলা আদালতে বিচারাধীন। ইতোমধ্যে রাজ্যটির সাবেক শিক্ষামন্ত্রী-সহ তার অধীনে কাজ করা অনেক কর্মকর্তা এখন জেলে। যে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাদের মাথার ওপর যেন খাঁড়া ঝুলছে।

এমনকি অভিযুক্ত শিক্ষকদের পদত্যাগও করতে বলেছে আদালত। অবশ্য মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘটনা সামনে এসেছে। কিন্তু গত রোববার যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।

নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। আদালতের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন ১৮৩ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই সুপারিশের নেপথ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ। তা খতিয়ে দেখতে সেই তালিকা ধরে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।

এই সংক্রান্ত একটি তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকদিন ধরেই ভাইরাল। আর এরপরই গত রোববার পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে এক শিক্ষিকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মৃত ওই শিক্ষার নাম টুম্পারানি মন্ডল। ৩০ বছর বয়সী এই শিক্ষিকা রাজ্যটির দেবীপুর মিলন বিদ্যাপীঠের বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন। চণ্ডীপুর থানার সরিপুর গ্রামে ভাড়াবাড়ি থেকে টুম্পাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

সূত্রের খবর, ২০১৬ সালে কমিশন যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, তাতে আবেদন করেন টুম্পা। ২০১৯ সালে নন্দীগ্রামের ওই স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন। স্বজনদের বক্তব্য, কমিশনের তালিকা বলে একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন টুম্পা। ওই তালিকায় ৫৮ নম্বরে তার নাম রয়েছে।

ওই ঘটনার পর শনিবার স্কুলে যাননি এই শিক্ষিকা। পরের দিন আত্মহত্যা করেন। কী কারণে টুম্পা আত্মহত্যা করেছেন তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাল তালিকায় নাম থাকার জন্য তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী বলছেন, ‘যারা নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন, টুম্পারানির এই পরিণতির জন্য তারাই দায়ী। ১৮৩ জনের নাম হিমশৈলের চূড়া। এটা ব্যক্তির নয়, সংগঠিত অপরাধ। রাজ্যকে এর দায় নিতে হবে।’

শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার শিক্ষিকার আত্মহত্যার খবরে স্তম্ভিত। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক ব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছেন যারা, মাছের মতো বড়শিতে যাদের গাঁথা হয়েছে, তাদের প্রাণ যাচ্ছে দুঃসহ লজ্জায়। তারা বুঝতে পারছেন কী অন্যায় করেছেন, অন্যায় করতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।’

বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনে শাসক দলের একাংশ যুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় এই অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে এই দুর্নীতির জাল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত বলে দাবি করা হয়েছে।

এর প্রমাণ অতীতে পাওয়া যায় যখন রাজ্যের সাবেক মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ের নিয়োগ আদালত বাতিল করে দেয়। সাবেক শিক্ষিকা অঙ্কিতা অধিকারীকে বেতনও ফেরত দিতে হয়েছে। শাসক দলের জেলবন্দি নেতা অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের নিয়োগ নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে।

বেআইনি ভাবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অনেকে ইতোমধ্যে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষত, গত ১ ডিসেম্বর এসএসসি-র তালিকা ভাইরাল হওয়ার পর।

প্রশ্ন উঠছে, যে টাকা অঙ্কিতাকে ফেরত দিতে হয়েছে, নিয়োগ বাতিল হলে বাকিদেরও কি একই পরিণতি হবে? লাখ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে কেউ চরম পথ বেছে নেবেন না তো?

টিএম