ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্ম বিভূষণ’ খেতাব পাচ্ছেন প্রয়াত ভারতীয় চিকিৎসক দিলীপ মহালনবিশ। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার বাংলাদেশি শরণার্থীকে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন তিনি।

বুধবার (২৫ জানুয়ারি) রাতে এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিলীপ মহালনবিশ, মুলায়ম সিং যাদব, জাকির হুসেন, কে এম বিড়লা এবং সুধা মূর্তিসহ চলতি বছর ১০৬ জন পদ্ম পুরস্কার পাচ্ছেন। দেশটির ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে ভারত সরকার বুধবার তাদের নাম ঘোষণা করে।

‘পদ্ম বিভূষণ’, ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মশ্রী’ নামে তিনটি ক্যাটাগরিতে ওই ১০৬ জনকে এই পদ্ম পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। মূলত শিল্প, সমাজকর্ম, পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বাণিজ্য ও শিল্প, চিকিৎসা, সাহিত্য ও শিক্ষা, ক্রীড়া, সিভিল সার্ভিসসহ বিভিন্ন খাতে কর্মকাণ্ডে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার দেওয়া হয়ে থাকে।

সংবাদমাধ্যম বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে বনগাঁ সীমান্তে কলেরায় আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচানোর নেপথ্যে মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন দিলীপ মহালনবিশ। বস্তুত, তার উপস্থিত বুদ্ধিতেই স্যালাইন সূচের মাধ্যমে ধমনীতে প্রবেশ করানোর বদলে পানীয়ের সাহায্যে খাওয়ানো শুরু হয়।

লবন-চিনি-বেকিং সোডার পানি দিয়ে সেসময় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষায় সহায়তা করেছিলেন দিলীপ, অথচ তখনও ওআরএসের প্রয়োগে স্বীকৃতিই দেয়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ঝুঁকি নিয়েই সেই কাজ করেছিলেন তিনি। পরে তার হাত ধরেই স্বীকৃতি পায় ওআরএস।

অবিভক্ত বাংলার কিশোরগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী গত বছরের অক্টোবরে কলকাতার একটি হাসপাতালে মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।

এদিকে ভারতের সমাজবাদী পার্টির প্রয়াত প্রধান মুলায়ম সিং যাদব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ক্যাটাগরিতে পদ্ম বিভূষণে ভূষিত হয়েছেন। এছাড়া জাকির হুসেন শিল্প খাতে পদ্ম বিভূষণ পেয়েছেন। কে এম বিড়লা বাণিজ্য ও শিল্পের জন্য পদ্ম ভূষণ এবং সুধা মূর্তি সামাজিক কাজের জন্য পদ্ম ভূষণ পেয়েছেন।

এর পাশাপাশি প্রয়াত বিনিয়োগকারী রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা, অভিনেত্রী রাভিনা ট্যান্ডন এবং মণিপুর বিজেপির সভাপতি থাউনাওজাম চাওবা সিংকেও পদ্ম পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট করে পুরস্কার প্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতীয় জাতির জন্য তাদের সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় অবদান এবং আমাদের উন্নয়নের গতিপথকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের প্রচেষ্টা উপকৃত করেছে।’

উল্লেখ্য, ১৯৫৮ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পাস করে সেখানেই শিশু বিভাগে ইনটার্নশিপ শুরু করেন দিলীপ। ১৯৬০ সালে লন্ডনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস চালু হলে প্রচুর ডাক্তারের চাহিদা দেখা দেয়। দিলীপ আবেদন করতেই সেখানে সুযোগ পান।

এরপর লন্ডনে ডিসিএইচ করেন তিনি। এডিনবরা থেকে এমআরসিপিও করেন। তারপর কুইন এলিজাবেথ হসপিটাল ফর চিল্ড্রেনে রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন এই বাঙালি চিকিৎসক। তখন তার বয়স মাত্র ২৮ বছর। ওই পদেও তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল কেয়ার ফেলো পদে যোগ দেন দিলীপ। তখন ওই প্রতিষ্ঠানের একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র ছিল পশ্চিমবঙ্গের বেলেঘাটার আইডি হাসপাতালে। কলেরা আক্রান্তদের চিকিৎসা হতো সেখানে।

পরে ভারতে ফিরে দিলীপ সেখানে যোগ দেন। শুরু করেন ওআরএস এবং স্পেশাল মেটাবলিক স্টাডি নিয়ে গবেষণার কাজ। হাতেকলমে সাফল্য পেলেও গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। তারপরই শুরু হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

সেসময় বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ। আর সেসব শিবিরে হঠাৎ দেখা দেয় কলেরার প্রাদুর্ভাব।

ক্রমশ তা মহামারির আকার নেয়। পরে কয়েক জনকে সঙ্গে করে সেখানে যান দিলীপ। তার চিকিৎসা শুরুর পর দুই মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে সাফল্য আসে। সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করেন রোগীরা।

টিএম