অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের দুই বছর পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার দেশটিতে জারি থাকা জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাসের জন্য বৃদ্ধি করেছে। বুধবার মিয়ানমারের জান্তা সরকার জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ায় আগামী আগস্টের মধ্যে দেশটিতে নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা আরও বিলম্বিত হতে পারে।

দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে বলেছেন, ‘জরুরি অবস্থা ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আরও ছয় মাসের জন্য বৃদ্ধি করা হবে।’ অভ্যুত্থানের নেতা ও দেশটির সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লেইংয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা আবারও কমান্ডার ইন চিফের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন।

মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্প্রচারমাধ্যম এমআরটিভি বলেছে, ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনডিএসসি) মিন অং হ্লেইংয়ের জারি করা জরুরি অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির অনুরোধ মঞ্জুর করেছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসে দেশটির সামরিক বাহিনী।

বুধবার মিন অং অং হ্লেইংয়ের বরাত দিয়ে এমআরটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করবে।

‘জনগণ যাতে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হারিয়ে না ফেলেন, সেজন্য আমাদের সরকার দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কাজ করবে।’ তবে কবে নাগাদ সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে সেবিষয়ে নির্দিষ্ট করে কোনও সময় ঘোষণা করেননি তিনি। দেশটির জান্তা সরকারের সমালোচকরা বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য আয়োজিত নির্বাচন এক ধরনের প্রতারণা হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে বলেছেন, যদিও সংবিধানের ৪২৫ ধারা অনুযায়ী, (জরুরি অবস্থা) কেবল দু’বার মঞ্জুর করার বিধান রয়েছে, তারপরও বর্তমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটি ছয় মাসের জন্য আরেকবার বাড়ানো যৌক্তিক।

দেশটিতে যখন সামরিক অভ্যুত্থানের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘নীরব ধর্মঘট’ পালন করেছেন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারী কর্মীরা, তখন জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর এই ঘোষণা এল। বুধবার দেশজুড়ে সাধারণ জনগণকে বাড়িতে অবস্থান এবং দোকান-পাট বন্ধ রেখে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছেন জান্তাবিরোধী গণতন্ত্রকামীরা।

মিয়ানমারের প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী তায়জার সান ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, সামরিক বাহিনী যে কারচুপির নির্বাচনের পরিকল্পনা করছে ‘জনগণ তা মেনে নেবে না’ বলে প্রমাণ করার জন্যই এই ধর্মঘট চলছে। ভিন্নধর্মী প্রতিবাদের দিনে ইয়াঙ্গুনের বাণিজ্যিক কেন্দ্রসহ দেশটির প্রধান প্রধান বিভিন্ন শহরের রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য দেখা যাচ্ছে।
 
দেশটির আরেক গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারী থিনজার শুনলেই ই বলেছেন, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ অব্যাহত রয়েছে; বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়।

তাদের ভিন্নধর্মী এই নীরব প্রতিবাদের দিনে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া। সামরিক বাহিনী বলেছে, দেশটি ‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হয়েছে। একই সঙ্গে চলতি বছর দেশটিতে জান্তা সরকার সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক কারাবন্দিদের সহায়তা দানকারী সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স বলছে, ভিন্নমত দমনে সামরিক জান্তার অভিযানে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ২ হাজার ৯০০ জন নিহত হয়েছেন।

সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসার পর দেশটির ১৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ৪০ হাজার ঘরবাড়ি, ৮০ লাখ শিশু স্কুলে যেতে পারছে না এবং জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, অন্তত দেড় কোটি মানুষ চরম খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। দেশটির বেশিরভাগ অংশে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। অভ্যুত্থানের পরপরই প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে এক বৈঠকে বসার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখনও বিরোধীদের সাথে কোনও ধরনের আলোচনায় বসেনি।

সূত্র: রয়টার্স, আলজাজিরা।

এসএস