করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে টালমাটাল হয়ে পড়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় জনবহুল দেশ ভারত। দৈনিক সংক্রমণের রেকর্ড টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আকাশচুম্বী। এর মাঝেই দেশটির অনেক রাজ্যে ভাইরাল এই রোগের টিকার সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মহামারি নিয়ন্ত্রণে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে দেশটি।

করোনায় সর্বোচ্চ আক্রান্তের দিন বুধবার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে মধ্যরাত থেকে লকডাউন জারি হচ্ছে। একই দিন দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে দেশজুড়ে লকডাউন জারি করা হবে কি না সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত আরো পরে নেওয়া হতে পারে বলে সরকারি কিছু সূত্র বলছে।

ভিন্ন চিত্রও আছে দেশটির অন্য প্রান্তে; উত্তরাঞ্চলে কুম্ভ মেলায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে এই মেলায় অংশগ্রহণকারীদের শতাধিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনী ডামাডোল বাজছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৫ জনে পৌঁছেছে। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন এক হাজার ২৭ জন। ফলে দেশটিতে মোট মৃত্যুর সংখ্যাও ১ লাখ ৭২ হাজার ছাড়িয়েছে। 

চলতি বছরের শুরুর দিকেও ভারতে দৈনিক সংক্রমণ ১০ হাজারের নিচে ছিল। ১৩৯ কোটি মানুষের এই দেশটিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ আকার ধারণ করে ২ এপ্রিলের পর। মানুষের অবাধ চলাফেরা এবং সামাজিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের কারণে করোনার এই বাড়-বাড়ন্ত উল্লেখ করে এর দায় জনগণের ওপর চাপিয়েছে দেশটির সরকার।

দেশটিতে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্র। ভাইরাসের বিস্তারের লাগাম টানতে আজ মধ্যরাত থেকে পুরোপুরি লকডাউনে যাচ্ছে রাজ্যের রাজধানী মুম্বাই; যা পুরো এপ্রিলজুড়ে অব্যাহত থাকবে। দেশটিতে মোট করোনা আক্রান্তের এক চতুর্থাংশই মহারাষ্ট্রের।

বুধবার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় আরেক রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, সেখানে অনেক রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

৬১ বছর বয়সী স্ত্রী শান্তাবেনকে নিয়ে ওই হাসপাতালে এসেছেন বেচারভাই ওয়াঘেলা। তিনি বলেন, রোববার আমার স্ত্রীর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দেওয়ায় আমরা আজ সকালে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে এসেছি। তিনি বলেন, ‌‘আমরা হাসপাতাল চত্বরের বাইরে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করেছি।’

প্রকাশ্যে কথা বলার অনুমতি না থাকায় হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, গুজরাটের অনেক বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। যে কারণে তারাও রোগীদের সরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছে। 

ভারতে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন বেশ কয়েকটি রাজ্যে ভ্যাকসিনের জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে।

দেশটির মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, পাঞ্জাব, দিল্লি, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এবং আসামে ভ্যাকসিন ফুরিয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এসব রাজ্য।

এর মধ্যে মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, ওডিশা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ঝাড়খণ্ড গত সপ্তাহেই ভ্যাকসিনের মজুত শেষ হয়ে আসছে বলে অভিযোগ করেছিল। এছাড়াও দেশটির অন্যান্য অনেক রাজ্যে সরবরাহ সংকটের কারণে টিকা নিতে আগ্রহী লোকজনকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

পাঞ্জাবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলবীর সিং সিধু বলেছেন, টিকার মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় সরকারের কাছে ১৫ লাখ ডোজের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র চার লাখ ডোজ। টিকার চরম ঘাটতির মাঝেই গত রোববার দেশজুড়ে টিকা উৎসবের উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। 

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে শক্তিশালী কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম রুশ বিজ্ঞানীদের তৈরি টিকা ‘স্পুটনিক-৫’ প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে ভারত। মহামারি মোকাবিলায় ভারত-সহ বিশ্বের অন্তত ৬০টি দেশ রাশিয়ার এই টিকার অনুমোদন দিয়েছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ও সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার তৈরি কোভিশিল্ড, ভারতের স্থানীয় কোম্পানি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিনের পর করোনার তৃতীয় টিকা হিসেবে সোমবার স্পুটনিক-৫ এর অনুমোদন দেয় দেশটি।

ব্লুমবার্গের ভ্যাকসিন ট্র্যাকার বলছে, ভারতে বুধবার পর্যন্ত মহামারি করোনাভাইরাসের টিকা ১১ কোটি ১০ লাখ ৩৩ হাজার ৯২৫ জনকে দেওয়া হয়েছে। আশঙ্কাজনক হারে সংক্রমণ এবং মৃত্যু বৃদ্ধি পাওয়ায় এই মহামারি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে দেশটির সরকার।

সূত্র: রয়টার্স, হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি।

এসএস