নাদিন পার (ডানে) ও তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোরাইয়া দীন।

রেহান জয়াবিক্রমে। শ্রীলংকার প্রধান বিরোধীদলের একজন তরুণ রাজনীতিবিদ। গত ১৩ এপ্রিল টুইট বার্তায় এক ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বিস্ময় সৃষ্টি করেন। তার ওই টুইট বার্তাটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরও তার রোজা রাখার বিষয়ে।

টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘আমি একজন বৌদ্ধ এবং আমি আমার জীবনে বৌদ্ধ দর্শন মেনে চলার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করি। এই কথা বলার পরও জানাতে চাই, আমি আমার মুসলিম ভাই ও বোনদের সাথে পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য অপেক্ষা করছি। এটাই হবে আমার জীবনে প্রথম রোজা রাখা। সুতরাং আমার জন্য প্রার্থনা করবেন।’

তার এই টুইটের পরদিন থেকে রমজান মাস শুরু হয় এবং তখন থেকে জয়াবিক্রমে দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত আছেন। তিনি শ্রীলংকার দক্ষিণাঞ্চলীয় ওয়েলিগামা শহরের আরবান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান।

মুসলিম বন্ধুদের সাথে ইফতার করছেন রেহান জয়াবিক্রমে

শ্রীলংকা একটি বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এবার রমজান যেদিন থেকে শুরু হয়েছে; সেদিনই আবার দেশটির সিনহালা ও তামিল জনগোষ্ঠী তাদের নববর্ষ পালন করছে।

কিন্তু শ্রীলংকার এই বহু-ধর্মবিশ্বাসের সমাজে একটা বড় আঘাত লাগে দুই বছর আগে ২০১৯ সালে। যখন ইসলামি চরমপন্থী জঙ্গিরা ইস্টারের দিন কয়েকটি গির্জায় আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়। এতে প্রায় ২৭০ জন মানুষ নিহত হয়।

জয়াবিক্রমে বলছেন, তিনি যে মাসব্যাপী একটি ইসলামী আচার পালন করছেন এর একটা লক্ষ্য হলো, সেই আক্রমণের পর দেশে যে মুসলিমবিরোধী মনোভাব জেগে উঠেছে তার মোকাবিলা করা।

রেহান জয়াবিক্রমের টুইটার ফিডে তার রোজা রাখার ঘোষণার পর তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রচুর মন্তব্য-জবাব পড়েছে। তবে এতে আরও প্রকাশ পেয়েছে যে একজন অমুসলিম হিসেবে রমজান পালন যে তিনিই প্রথম করছেন তা মোটেও নয়।

শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বোতে থাকেন ম্যারিয়ান ডেভিড। যিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনিও জানালেন যে, তিনি বেশ কিছু কাল ধরেই এটা করে আসছেন।

বিবিসিকে ম্যারিয়ান বলেন, ‘আমি একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং আমি রমজানের সময় রোজা রাখি। এর ফলে আমার মনে একটা দারুণ স্পষ্টতা, সচেতনতা, সহমর্মিতা এবং শৃঙ্খলা আসে। আশা করি জয়াবিক্রমে যেন ভালোভাবেই এটা করতে পারেন।’

শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আন্তর্জাতিক বিষয়ক মহাপরিচালক অনুরাধা কে হেরাথ বলছেন, তিনিও একবার রমজান মাস পালন করেছেন। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘বহুদিন আগে যখন মোরাতুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন আমিও একবার রোজা রেখেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধু সিফান আমাকে অনেক ভোরে জাগিয়ে দিতো খাওয়ার জন্য। বিকেলে লেকচারের ফাঁকে রোজা ভাঙার সময় সে আমার সাথে তার হালকা খাবার ভাগ করে নিতো। আমি আশা করি আপনার (জয়াবিক্রমে) এ অভিজ্ঞতাটা চমৎকার লাগবে।’

ক্যাথলিক ম্যারিয়ান ডেভিড গত ১৫ বছর ধরে রোজা রাখছেন

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে

রেহান জয়াবিক্রমে বলছিলেন, ‘আমাদের দেশের কিছু নেতা যে বর্ণবাদকে উস্কে দিচ্ছেন, তার বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ হিসেবেই আমি এটা করার চিন্তা করি। রোজা রাখার অর্থ এই নয় যে আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। আমি বর্ণবাদের প্রতিবাদ করছি।’

বিবিসিকে বলেছেন, ইস্টার সানডের হামলার পর থেকে শ্রীলংকায় মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দানব হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। শ্রীলংকার জনগোষ্ঠীর ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ। বাকিরা হিন্দু, মুসলিম ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান।’ 

জয়াবিক্রমে বলেন, ‘আমি যখন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দেখাই যে তাদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে আমাদের মমত্ববোধ আছে, তখন এটা তাদের একটা নিরাপত্তার বার্তা দেয়।

রেহান জয়াবিক্রমের কিছু সমালোচক অবশ্য অভিযোগ করেছেন, এর উদ্দেশ্য মুসলিমদের ভোট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

এর জবাবে জয়াবিক্রমে টুইটারে দেওয়া তার এক সমর্থকের বার্তা উদ্ধৃত করেন, যাতে বলা হয়, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করে ভোট পাওয়াটা ঘৃণা সৃষ্টির চেয়ে অনেক ভালো।

নাদিন পার সাত বছর ধরে রোজা রাখছেন

অন্যদের খাওয়ানো

সাংবাদিক ম্যারিয়ান ডেভিড। তিনি একজন ক্যাথলিক। কিন্তু তারপরও গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে রমজানের রোজা রেখে আসছেন। তিনি বলছেন, এ সময়টাকে তিনি ব্যবহার করেন মনসংযোগ এবং সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার জন্য।

ম্যারিয়ান বলেন, ‘কি খাবো তা নিয়ে সার্বক্ষণিক চিন্তা, খাদ্যের জন্য মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাওয়া এবং অকারণে একটু পর পর খাওয়া। এগুলো থেকে অনেকটা রেহাই পাওয়া যায় রোজা করার ফলে। এটা দিনটাকে একটা শৃঙ্খলার ভেতর নিয়ে আসে।’

তিনি মনে করেন রোজা তার মনঃসংযোগকে শাণিত করে এবং নিজেকে অনেক স্বাস্থ্যবান মনে হয়। তিনি বলেন, ‘যারা জীবনমান ও চাকরির কারণে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করছেন; তাদের জন্য দিনের বেলা না খেয়ে থাকাটা বিরাট কোন ত্যাগ নয়।’

ম্যারিয়ান বলছেন, ‘যে মানুষরা কায়িক শ্রম করেন কিংবা প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও বাইরে কাজ করেন, যাদের উন্নত বা স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অর্থ নেই; তাদের জন্য এই সময়টা সবচেয়ে কষ্টকর।’

তার মতে, রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, শ্রীলংকায় যাদের একবেলার খাবার জোটাতে কষ্ট করতে হয়। তাদের কথা চিন্তা করা। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, দান করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

‘আমার মনে হয় উপবাস করার পাশাপাশি যতটা পারা যায় দান করা, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের খাওয়ানো এবং তাদের রোজা রাখতে সহায়তা করাটা সমানভাবে প্রয়োজনীয়।’

ম্যারিয়ানের বাড়িতে ইফতারের আয়োজন

সংহতি

পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা নাদিন পার। তিনিও আরেকজন অমুসলিম যিনি রমজান পালন করেন। তিনি একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান এবং তাকে রমজানের কথা জানিয়েছিলেন তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী একজন মুসলিম নারী।

তিনি বলেন, ‘এটা আমার মুসলিম বন্ধুদের সাথে সংহতি প্রকাশের একটা উপায়, তা ছাড়া যীশুর অনুসারী হিসেবে আমার নিজের ধর্মবিশ্বাসেরও একটি বহিঃপ্রকাশ।

নাদিন একজন লেখক, ব্যবসা প্রশিক্ষক এবং একজন স্কুল শিক্ষক। তিনি থাকেন মিশিগান অঙ্গরাজ্যের গ্র্যাণ্ড র‍্যাপিডসে।

‘গত সাত বছর ধরে পানি পানের বিধিনিষেধটির ক্ষেত্রে একটা রফা করে আমি রমজানের উপবাসের নিয়ম মেনে চলছি। তখন আমি সকালের খাবার খাই সূর্যোদয়ের আগে আর সূর্যাস্তের আগে পর্যন্ত সবরকম খাওয়া থেকে বিরত থাকি।’

তিনি বলছেন, এটা তার কাছে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধুদের সাথে সেতুবন্ধনের শামিল। নাদিনের মতে মানবতা সবক্ষেত্রে সমান।

‘ইচ্ছাকৃত শারীরিক সংযমের ফলে একটা আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি হতে পারে- এই ভাবনায় বছরের একটা সময় পানাহার থেকে দূরে থাকা, এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা কতটা পরস্পরের সাথে যুক্ত। আমি সেটাই উদযাপন করি।’

নাদিন পার একজন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান - যিনি মনে করেন রোজা রেখে তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য অনুভব করেন।

সবার সাথে মিলিত হবার সময়

শ্রীলংকার ম্যারিয়ান ডেভিড বলছেন, এটা শুধু ত্যাগ বা শৃঙ্খলার সময় নয়। এটা সবার সাথে সময় কাটানো এবং প্রিয়জনদের সাথে উদযাপনেরও সময়।

‘আমরা যখন বাইরে যাই, বন্ধু বা পরিবার নিয়ে রোজা ভাঙার জন্য বসি তখন এটা একটা ডিনার পার্টির মতই লাগে। শুধু মদ্যপান ছাড়া। আমরা নতুন নতুন খাবার চেখে দেখি। অনেক মজা করি, যদিও খাওয়ার পরিমাণ কিছুদিন বাদেই অনেকটা কমে যায়।’

‘তবে আপনি সত্যি সত্যি যে জিনিসটার অভাব অনুভব করবেন তা হলো পানি। বিশেষ করে এ আবহাওয়ায়। তবে এর সুফল এই ত্যাগের চেয়ে বেশি। প্রথমে আমি পানির অভাবটাই বোধ করতাম। বাকি সবকিছুই সহজ, যদি আপনার এটা করার সংকল্প থাকে।’

নাদিনের জন্য এই উপবাস এখন তার আধ্যাত্মিক জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে।

নাদিন বলছেন, ‘যারা ক্লান্ত এবং উত্তর খুঁজছেন তাদের জন্য এটা চাই। যদি আমরা সবসময়ই আমাদের ইচ্ছা পূরণের চেষ্টায় থাকি, আমরা হয়তো পবিত্র মুহূর্ত বা স্থানগুলো হারাতে পারি। যা স্বয়ংক্রিয়তার মধ্যে ঢুকে যাওয়া এবং ঈশ্বরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করার কথা ভুলে যাওয়াটা খুবই সহজ।’

তিনি মনে করেন, খাদ্য ও পানি ছাড়া থাকার ফলে তার ধর্মবিশ্বাস এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছে। তার মতে, ‘আমরা যখন আমাদের প্রয়োজনকে অতিক্রম করে দেখতে শিখি তখন আমাদের চাহিদাগুলো অন্যরকম হয়ে যায়। আমরা ঈশ্বরকে অনুভব করি।’

সহজ নয়

অবশ্য রেহান জয়াবিক্রমের জন্য এই নতুন নিরীক্ষা খুব সহজ হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি ভোর চারটায় উঠে কিছু খেজুর, দই এবং ফল খেয়েছি। তার পর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত কিছুই খাইনি।’

তেবে বিবিসিকে অবশ্য তিনি বলেন, নতুন এই অভিজ্ঞতার পর তার দিন শেষে নিজেকে বেশ সতেজ লেগেছে। কিন্তু পুরো এক মাস ধরে তিনি এটা চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে তার সন্দেহ আছে।

এই বৌদ্ধ রাজনীতিবিদ বলছেন, ‘যতদিন পারি আমি চালিয়ে যাবো।’ তবে তিনি সমবেদনার সাথেই বলছেন, ‘পানি পান না করে থাকাটা সত্যি কষ্টকর।’

সূত্র: বিবিসি

এএস