বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ টিকা উৎপাদনকারী দেশে করোনা টিকার ঘাটতি দেখা দেওয়ায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটির গণটিকাদান কর্মসূচি। পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কোভিশিল্ডের জোগানে ভাঁটা পড়েছিল আগেই, বুধবার (১২ মে) কোভ্যাক্সিনের প্রস্তুতকারী কোম্পানি ভারত বায়োটেকও তাদের নতুন করে আর টিকা দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

ভারতের গণটিকাদান কর্মসূচিতে এতদিন তিনটি করোনা টিকা ব্যবহার হয়ে আসছিল— অ্যাস্ট্রাজেনেকা, কোভিশিল্ড ও কোভ্যাক্সিন। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও কোভিশিল্ডের ডোজগুলো প্রস্তুত হয়েছিল সেরাম ইনস্টিটিউটে, অন্যদিকে ভারতের ওষুধপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক বাজারে এনেছে করোনা টিকা কোভ্যাক্সিন।

বস্তুত গত ১৬ জানুয়ারি ভারতে মহাধূমধামে যে বিশাল টিকাকরণ অভিযান শুরু হয়েছিল, একশো দিন যেতে না-যেতেই সেই কর্মসূচি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। টিকার ডোজের ঘাটতির কারণে দিল্লিতে শতাধিক ভ্যাক্সিনেশন সেন্টার এর ফলে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

বুধবার এক টুইটবার্তায় দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীষ সিসোদিয়া অভিযোগ করেন, ‘কোভ্যক্সিন প্রস্তুতকারী কোম্পনি আমাদের জানিয়েছে টিকার ঘাটতি ও সরকারের নির্দেশনা থাকার কারণে তারা দিল্লিতে টিকা সরবরাহ করতে পারবে না।’

‘আমি আবার বলছি, ৬ কোটি ৬০ লাখ টিকার ডোজ রফতানি করা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় ভুল। টিকার ডোজের ঘাটতির কারণে দিল্লির ১০০ টিরও বেশি টিকাকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি আমরা।’

ওই দিনই এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে সিসোদিয়া বলেন, ‘কোভ্যাক্সিনের নির্মাতা সংস্থা আমাদের চিঠি লিখে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছে তারা দিল্লিকে টিকা দিতে পারবে না - কারণ তাদের কাছে দেওয়ার মতো না কি কোনও টিকাই নেই।’

তিনি আরও অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারাই এই টিকার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন; আর তাদের বিমাতৃসুলভ আচরণের কারণেই দিল্লিতে কোভ্যাক্সিনের শতাধিক টিকাকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে আম আদমি পার্টি।

মনিষ সিসোদিয়া সংবাদ সম্মেলন ডাকার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন ডাকেন ক্ষমতাসীন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিত পাত্র। সেখানে তিনি দাবি করেন, টিকার জোগান বাড়ানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে এখন টিকার ফর্মুলা দিয়ে টিকা বানানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

সম্বিত পাত্র বলেন, ‘মহারাষ্ট্রের হ্যাফকিন বায়োফার্মা, ইন্ডিয়ান ইমিউনোলজিক্যাল লিমিটেড, ভারত ইমিউনোলজিক্যালস এরকম তিন-চারটি সরকারি সংস্থাকে কেন্দ্র কোভ্যাক্সিন বানানোর নির্দেশ দিয়েছে।’

‘ভারতের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিএমআর-ও নানা সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছে, বলছে তোমরা আমাদের কাছ থেকে ফর্মুলা নাও, টিকা বানাও!’

এদিকে, রাজধানী নয়াদিল্লি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চরম অব্যবস্থাপনা চলছে টিকাদান কর্মসূচিতে। টিকাপ্রত্যাশীরা অ্যাপে বুকিং পাচ্ছেন না, টিকাকেন্দ্রে গিয়েও তাদের হতাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে বা চূড়ান্ত নাকাল হতে হচ্ছে বলে বেশ কিছু  অভিযোগ এসেছে দিল্লির বাইরের রাজ্যগুলো থেকে।

কোউইন নামে যে সরকারি অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করে টিকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার কথা সেখানে স্লট মিলছে না ; আবার সাতসকালে টিকাকেন্দ্রে গিয়েও করেও নিরাশ হতে হচ্ছে বহু লোককেই।

পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ার একটি টিকাকেন্দ্রে গত সপ্তাহে এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল সীমা ঘোষালের।সকাল পৌনে ছটার সময় টিকাকেন্দ্রে পৌঁছেও তিনি শোনেন, সর্বোচ্চ যে ১৩০জনকে সেদিন টিকা দেওয়া যাবে এবং যাদের টিকা দেওয়া হবে, তাদের সবার নাম লেখা হয়ে গেছে - তার আর সেদিন সুযোগ মিলবে না।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "অত সকালেও এসে শুনি দেড়শোজনের বেশি না কি নাম লেখা হয়ে গেছে! অথচ তখন সেখানে মাত্র পাঁচ-সাতজন দাঁড়িয়ে, সেন্টারের গেটও বন্ধ।"

‘তাহলে কারা নাম লিখল? কাদের নাম লিখল? আর তারা গেলই বা কোথায়, তা তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’, বলছিলেন তিনি।

আবার টিকাকেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড়, ঘেঁষাঘেঁষি লাইনের জন্য সংক্রমণের ভয় পাচ্ছিলেন আরেক টিকাপ্রত্যাশী নারী আলো বণিক।

পশ্চিমবঙ্গের একটি জনাকীর্ণ টিকাকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিবিসি বাংলাকে আলো বণিক বলেন, ‘এত ভিড় ঠেলে কেন ভ্যাক্সিন নিতে ঢুকতে যাব বলুন তো?’

‘করোনার ভ্যাক্সিন নিতে এসেই যদি এই গাদাগাদি ভিড়ে করোনায় আক্রান্ত হই, তার চেয়ে তো বাড়িতে বসে থাকাই ভাল’, চরম বিরক্তির সঙ্গে বলছিলেন তিনি।

ভারতের বৃহত্তম বায়োফার্মা কোম্পানি বায়োকনের কর্ণধার কিরণ মজুমদারও সরাসরি বলছেন, "ভারতে টিকাদান কর্মসূচির গতি যে হারে কমছে তাতে আমি রীতিমতো উদ্বিগ্ন বোধ করছি।"

‘বহু সেন্টারে টিকার জোগান আসছে না, আবার কোনও কোনও সেন্টার তাদের নির্ধারিত কোটাই দিয়ে উঠতে পারছে না। কোথাও তো কিছু একটা ভুল হচ্ছেই।’

টিকাদান কর্মসূচির অঙ্কগুলো কষার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে ও পরিকল্পনায় যে মারাত্মক ভুল হয়েছিল, সেটা ভারতে আজ ‘দিনের আলোর মতো স্পষ্ট’ উল্লেখ করে কিরণ মজুমদার বলেন, ‘জানুয়ারিতে ভ্যাক্সিন অনুমোদন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন আমরা নির্মাতা সংস্থাগুলোকে অর্ডার দিইনি, চাহিদার হিসেব কষে সাপ্লাই শিডিউল তৈরি করিনি?’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এসএমডব্লিউ