ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলমান সংঘাত এতটাই বড় আকার নিয়েছে যে, এটা শেষ পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে জাতিসংঘ।  

গেল এক মাস ধরে জেরুজালেমে দু’পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তবে সেগুলো ছোট ছোট সংঘাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ওই সংঘাত বড় সংঘাতে পরিণত হয়েছে। 

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বেথেলহেম

শত বছরের সংঘাত
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বিরোধ আসলে কয়েক দশকের পুরোনো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিন বলে পরিচিত এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় ব্রিটেন।  

সেখানে তখন আরবরা ছিল সংখ্যাগুরু, আর ইহুদিরা সংখ্যালঘু।  

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনেকে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব দিলে ওই অঞ্চলে আরব মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে উত্তেজনা শুরু। 

ইহুদিরা ফিলিস্তিনকে তাদের পূর্বপুরুষদের আবাসস্থল বলে দাবি করে। আরবরাও একই দাবি করে এবং ওই অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা শুরু করে। 

১৯৪৮ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বন্দুক হাতে একজন ইহুদি যোদ্ধা

১৯২০ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে ওই অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মধ্যে অনেকে ছিলেন যারা অত্যাচার থেকে বাঁচতে ইউরোপ থেকে পালিয়ে সেখানে যান। এরইমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদিদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি জোরালো হতে থাকে। 

একদিকে যেমন আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি জোরালো হতে থাকে, অন্যদিকে ইহুদিদের সাথে আরবদের সংঘাত বাড়তে থাকে। আবার ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনও বাড়তে থাকে। 

ফিলিস্তিনকে দু’টুকরো করে ইহুদি ও আরবদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবের ওপর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে ভোটাভুটি হয়। এতে জেরুজালেমকে কোনো একটি পক্ষের হাতে না দিয়ে আন্তর্জাতিক নগরী রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়। 

ইহুদিরা এ পরিকল্পনার পক্ষে ছিলেন। তবে আরবরা এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় সেটা আর বাস্তবায়ন হয়নি। 

ইহুদি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরব যোদ্ধারা

ইসরায়েলের জন্ম ও আল নাকবা 
সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান না করেই ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল নামে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিয়ে ১৯৪৮ সালে ওই অঞ্চল ছাড়ে ব্রিটিশরা। 

বহু ফিলিস্তিনি এর বিরোধিতা করে আর শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর জেরে হাজারো ফিলিস্তিনিকে তাদের বসতভিটা ছেড়ে পালাতে হয়। এ ঘটনাটিই আল নাকবা নামে পরিচিত। 

পরের বছর যখন যুদ্ধবিরতির কারণে সংঘাত কিছুটা থামে ততক্ষণে ওই অঞ্চলের বেশিরভাগই ইহুদিদের দখলে চলে এসেছে।  

কিছু অংশ জর্ডানের দখলে যায়, যা পরে পশ্চিম তীর নামে পরিচিতি পায়। আর মিসর দখল করে গাজা।  

জেরুজালেমের পশ্চিম অংশ যায় ইসরায়েলিদের হাতে আর পূর্ব অংশ যায় জর্ডানের বাহিনীর দখলে। 

যেহেতু এখানো কোনো শান্তি চুক্তি ছিল না, তাই দু’পক্ষ সবসময়ই একে অপরকে দুষেছে। পরবর্তীতে দু’পক্ষ আরও বহুবার যুদ্ধে জড়ায়।

১৯৬৭ সালে এরকমই আরেক যুদ্ধে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। একইসঙ্গে সিরিয়ার গোলান এবং গাজা ও মিসরের সিনাই উপত্যকাও দখলে নেয় তারা।

বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি শরণার্থী ও তাদের বংশধররা গাজা এবং পশ্চিম তীরে বাস করেন। পার্শ্ববর্তী জর্ডান, সিরিয়া ও লেবাননের কিছু অংশেও রয়েছে তাদের বাস।

এই শরণার্থী বা তাদের বংশধরদের কাউকেই ইসরায়েল কখনও তাদের জন্মভূমিতে ফিরতে দেয়নি। কারণ, ইসরায়েল মনে করে তারা যদি ফিরতে পারে তবে তা ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলবে।

ছয়দিনের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেম দখলে নেওয়ার পর সেখানে পৌঁছান ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তরা

ইসরায়েল এখন পশ্চিম তীর দখল করে রেখেছে। জাতিসংঘ গাজাকে এখনও দখলিকৃত অঞ্চল বলেই মনে করে। 

গোটা জেরুজালেমকে নিজেদের রাজধানী বলে দাবি করে ইসরায়েল। অন্যদিকে ভবিষ্যতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হলে তাদের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম, এমন দাবি ফিলিস্তিনিদের। বিশ্বের সামান্য যে কটা দেশ জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি। 

গত ৫০ বছরে এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছে ইসরায়েল; যেখানে প্রায় ৬ লাখ ইহুদির বাস। 

ফিলিস্তিনিদের দাবি আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী এ বসতি অবৈধ এবং শান্তির পথে বাধা। তবে ইসরায়েল এসব মানতে নারাজ।  

এখন কী হচ্ছে 

পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে বাস করা ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরায়েলের সংঘাত লেগেই থাকে।

হামাস নামে একটি যোদ্ধাগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করে গাজা। এই হামাস ইসরায়েলের সঙ্গে বহুবার যুদ্ধ করেছে। ইসরায়েল ও মিসর তাদের সীমানা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যাতে হামাসের হাতে বাইরে থেকে কোনো অস্ত্র না পৌঁছায়।

গাজা এবং পশ্চিম তীরে বাস করা ফিলিস্তিনিরা বলেন, ইসরায়েলি বাধানিষেধ আর কর্মকাণ্ডের কারণে তাদের অনেক ক্ষেত্রেই ভুগতে হয়। অন্যদিকে ইসরায়েল বলে তারা ফিলিস্তিনি সংঘাত থেকে কেবল নিজেদের রক্ষা করছে।

সাম্প্রতিক সংঘাতের শুরু রমজানের প্রথম দিকে। তখন পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের সংঘর্ষ হয় কয়েক দফায়।

পূর্ব জেরুজালেম থেকে কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদের হুমকি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে।

সীমান্তের কাছে ইসরায়েলি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ফিলিস্তিনিরা। তাদের ঠেকাতে টিয়ার গ্যাস ছোড়া হচ্ছে।

আসল সমস্যাটা কোথায়
বেশ কিছু বিষয় আছে যেগুলোকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন কখনও ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে না।

এর মধ্যে রয়েছে- ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ভবিষ্যৎ কী? পশ্চিম তীরে যে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হয়েছে তা থাকবে না তুলে দেওয়া হবে? জেরুজালেম কার হাতে যাবে? আর এগুলোর সাথে সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হলো ফিলিস্তিন নামে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা হবে কি-না?

এসব প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে ২৫ বছর ধরে নানাভাবে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু সমাধান আসেনি। 

ভবিষ্যত কী? 
সংক্ষেপে বলা যায়, সহসাই কোনো সমাধান আসছে না। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র যে শান্তি পরিকল্পনা হতে নিয়েছিল ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী সেটাকে শতাব্দীর সেরা পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করলেও একে একপাক্ষিক বলে প্রত্যাখ্যান করে দেয় ফিলিস্তিনিরা। 

ভবিষ্যতেও যেকোনো শান্তি চুক্তির জন্য দু’পক্ষকেই বেশ কিছু জটিল বিষয়ের সমাধান করতে হবে। 

আর তা না হওয়া পর্যন্ত এ সংঘাত চলতেই থাকবে। 

সূত্র : বিবিসি ।  

এনএফ