মাথায় গুলি লাগার পর আর দাঁড়াতে পারেনি ১৬ বছরের বার্নাত
ফিলিস্তিনের রামাল্লার উপকণ্ঠে বিল্লিন গ্রামে একদল শিশু তাদের বন্ধুর কবরের পাশে দাঁড়িয়েছিল। গাজায় ইসরাইলি বোমা হামলা ও ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নিয়ে চলমান আন্দোলনে তাদের ১৬ বছর বয়সী বন্ধু ইসলাম ওয়েল বার্নাত ১৮ মে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন।
ইসলামের কবরের সামনে কয়েকজন বন্ধু দাঁড়িয়ে তার স্মৃতিচারণ করছিল। কবর থেকে কী আবারও বার্নাতকে বের করে আনা সম্ভব? তার থেমে যাওয়া জীবন কী আবার নতুন করে শুরু করতে পারবে? হয়তো তার একটু ভুল হয়ে গেছে- ইসলাম বার্নাতের এক বন্ধু অসহায়ভাবে বলছিল। অপর এক বন্ধু বলছিল, ইসলাম কী সত্যিই এই কবরে শুয়ে আছে?
বিজ্ঞাপন
বার্নাতের বন্ধুরা তার মৃত্যু মেনে নিতে পারছিল না। তার দ্রুত বিদায় তাদের সহ্য হচ্ছিল না। তার বন্ধুরা বলছিল, ইসলাম ছিল গ্রামের সবচেয়ে ভাল ছেলেদের একজন।
ফিলিস্তিনিদের সাধারণ ধর্মঘটের মধ্যেই বার্নাত হত্যার ঘটনা ঘটে। ১৮ মে ফিলিস্তিনের বাসিন্দারা রাস্তায় নেমে এসেছিল। এ দিন জেরুজালেমের শেখ জাররাহ থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও গাজায় হামলার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের আন্দোলন চলছিল।
বিজ্ঞাপন
দখলকৃত পশ্চিমতীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ১৮ মে চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে রামাল্লার তিনজন। পশ্চিম তীরে এরই মধ্যে ২৯ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বার্নাত সবচেয়ে কম বয়সী।
ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বিল্লিন গ্রামের আবু লাইমুন এলাকায় ১৮ মে বিকেলে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের সঙ্গে ইসলাম বার্নাতও যোগ দেয়।
স্থানীয়রা জানান, ইসরায়েলি সেনারা দ্রুত সেখানে অবস্থান নেয়। এসময় সেনারা টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড বোমা নিক্ষেপ করে। ইসরায়েলি সেনারা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সব সময়ই এসব অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
ইসলাম বার্নাত আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি
বিল্লিন গ্রামের বিক্ষোভে ইসলাম বার্নাতের সঙ্গে তার ১৪ বছর বয়সী বন্ধু আব্দুল্লাহ জায়েদও যোগ দিয়েছিল। তিনি বলেন, আমি অনেক ভীত ছিলাম। গুলাগুলির সময় পেছনে দিকে এসে বিক্ষোভকারীদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ গুলির শব্দ শুরু হলে সবাই শুয়ে পড়ে। উঠার পর দেখি ইসলাম আর দাঁড়ায়নি। তার মাথার রক্তে সব ভেসে যাচ্ছে। তখন বিক্ষোভকারীরা তাকে নিয়ে দৌড়ানো শুরু করে।
জায়েদ বলছিল, আহত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই চিকিৎসকরা ইসলাম বার্নাতকে মৃত ঘোষণা করে। বার্নাত খুবই হাসিখুশি থাকত। সে আমাদের বেশ হাসাতো। আমরাও তার সঙ্গে ভাল সময় কাটিয়েছি। সে সব সময় অন্যের ভাল চেয়েছে। সে কাউকে কষ্ট দিয়েছে এমনটা আমরা মনে করতে পারি না।
ইসলাম বার্নাতের মা জান্না তার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন। তিনি ভাবতেই পারছেন না তার চার সন্তানের একজন আর নেই। তিনি বাড়িতে চুপচাপ বসে থাকেন। বার্নাতের বাবা ওয়েল শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তিনি কোনো কথা বলছেন না। শুধু সন্তানের জন্য কাঁদছেন।
বার্নাতের ৭৫ বছর বয়সী দাদি ইন্তিজার বার্নাত বলেন, তার পরিবার ইসরায়েলি বসতি স্থাপন ও জমি বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে বিল্লিনের সাপ্তাহিক প্রতিবাদে সবসময় শামিল থাকত।
তিনি বলেন, ওই দিনের প্রতিবাদে সবাই শামিল হতে পারেননি। জান্না বাড়ির কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বিক্ষোভে অংশ নিতে পারেননি। বিক্ষোভ শুরু হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই আমরা বার্নাতের আহত হওয়ার খবর পাই।
ইন্তিজার তার নাতির জন্য কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, বার্নাত তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করত। সে ভেড়া আর গাছগুলোর পরিচর্যা করত। বার্নাত খুবই দরদী ছিল। সে কখনো আমাকে ছেড়ে থাকেনি।
তিনি বলেন, আমি জানি না তাকে ছাড়া বাকি জীবন কীভাবে কাটাব! তার কথা মনে হলেই আমার মন ছারখার হয়ে যায়। তার মৃত্যু আমাদের জন্য অনেক বড় ধাক্কা।
বার্নাত তার স্বপ্ন পূরণের আগেই চলে যাবে এটা আমরা ভাবতে পারি না। সে তার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে স্কুলের সেরা ছাত্র হয়ে পড়াশোনা শেষ করবে।
তার পরিবার জানায়, বার্নাত ফুটবল খেলার জন্য তার গ্রামে বিখ্যাত ছিল। সে শুধু ফুটবল খেলা নয় বরং ছোটদের ফুটবলের নানা কৌশল শেখাত। তাদের নিয়ে দল বানিয়ে উঠানে খেলত।
আমরা গতকালও একসঙ্গে খেলেছি
বার্নাতের ১১ বছর বয়সী আত্মীয় নুরসেন বলেন, আমরা গতকালও একসঙ্গে খেলেছি। ওই সময় তার সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগেছিল। এতে আমি রাগ করে করে চলে যাই। আজ আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সে যাই করুক না কেন, তার সঙ্গে আর কখনো রাগ করব না। আমি শুধু তাকে ফিরে পেতে চাই।
রমজান মাসে বার্নাত গ্রামের বাৎসরিক স্পোর্টস লিগে অংশ নিয়েছিল। তার সহপাঠী খেলোয়াড় ইসা আবু রাহমা বলেন, বার্নাত যে দলের হয়ে খেলায় অংশ নিয়েছিল সেই দলেন নাম ছিল ‘আল আকসার শহীদেরা’। আজ সত্যিই সে শহীদ। বার্নাত সত্যিই খুব অসাধারণ ও ভাল খেলোয়াড় ছিল।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বার্নাতের পরিবার নতুন বাড়িতে উঠেছিল। সেখানে ইসলাম তার ১০ বছর বয়সী ছোট ভাই মুহাম্মদের সঙ্গে থাকত।
মুহাম্মদ জানায়, আজ আমি আমার নতুন রুমে একা শুয়ে আছি। আমার ভাই, যার সঙ্গে আমি দুষ্টুমি আর খেলাধুলা করতাম সে আর নেই। ইসরায়েলি সেনারা তাকে হত্যা করেছে।
বার্নাতের ভাই আরও জানায়, বিক্ষোভে যাওয়ার আগেও সে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই রান্না করেছিল। ওই সময় সে আমাকে বলেছিল, বিক্ষোভে আমার সঙ্গে কিছু ঘটলেও বাবা-মা যেন কান্নাকাটি না করেন। সে নিহত হওয়ার আশা করেনি। বার্নাত ভেবেছিল সে হয়তো আটক বা আহত হতে পারে।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই
ওএফ