সৌদিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে উল্লম্ফনের নেপথ্যে কী?
সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার নজিরবিহীন গতিতে বৃদ্ধি করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। দেশটিতে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ২০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। এর ফল মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হিসেবে গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে সৌদি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মাদক চোরাচালান দমনে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় উপসাগরীয় দেশটিতে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকরের এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আরব বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ সৌদি আরব বর্তমানে ক্যাপটাগন নামের অবৈধ এক উত্তেজক মাদকের অন্যতম বৃহৎ বাজারে পরিণত হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ক্ষমতায় থাকাকালীন সিরিয়ার সর্ববৃহৎ রপ্তানি পণ্য ছিল ক্যাপটাগন। গত ডিসেম্বরে বিদ্রোহীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন আসাদ।
সৌদি আরবে ২০২৪ সালে ৩৩৮ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়; যা ১৯৯০-এর দশকে সর্বোচ্চ এই সাজা কার্যকরের রেকর্ড রাখা শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। চলতি বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কেবল মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধের দায়ে ১৪৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে সৌদি আরব। যদিও এ বছর দেশটিতে মোট ২১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
বিশ্লেষকরা ২০২৩ সালে শুরু হওয়া ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’র সঙ্গে বর্তমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনার সংশ্লিষ্টতা দেখছেন। তারা বলেছেন, সেই সময় গ্রেপ্তারকৃতদের দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে বর্তমানে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছে।
প্রায় তিন বছর মাদক মামলায় মৃত্যুদণ্ডের সাজা স্থগিত রাখার পর ২০২২ সালের শেষ দিকে সৌদি আরবের সরকার আবারও সর্বোচ্চ এই সাজা কার্যকর করা শুরু করে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ২০২২ সালে ১৯ জন, ২০২৩ সালে ২ জন এবং ২০২৪ সালে ১১৭ জনকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়।
মাদকবিরোধী অভিযানে সৌদি কর্তৃপক্ষ দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক ও সীমান্ত তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। সেখানে লাখ লাখ মাদক ট্যাবলেট জব্দ এবং কয়েক ডজন চোরাচালানকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ওয়াশিংটনের নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক ক্যারোলাইন রোজ বলেন, এটা পরিষ্কার যে, মাদক সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির পথ বেছে নিয়েছে সৌদি আরব। তবে এই বিষয়ে এএফপির কোনও প্রশ্নের জবাব দেননি সৌদি আরবের কর্মকর্তারা।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে মাদকবিরোধী অভিযানে বিদেশি নাগরিকরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ, গৃহকর্মী ও আতিথেয়তা খাতের জন্য বিদেশি শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করে আসছে।
লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রিপ্রিভের কর্মকর্তা জীদ বাসিউনি বলেন, সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকরা ন্যায়বিচার ও সুবিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। দেশটিতে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ১২১ জন বিদেশি নাগরিককে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে; যাদের বেশিরভাগই মাদক-সংশ্লিষ্ট অপরাধে দোষী সাব্যস্ত।
চলতি মাসের শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের এই ঊর্ধ্বগতির তীব্র সমালোচনা করে। সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক উপ-পরিচালক ক্রিস্টিন বেকারলে বলেন, ‘‘আমরা এক ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ্য করছি, যেখানে বিদেশিদের ক্রমবর্ধমান হারে এমন অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে—যেগুলোর জন্য কখনই মৃত্যুদণ্ড প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়।’’
সৌদি নাগরিকরাও এই দণ্ডের শিকার হচ্ছেন। দেশটিতে গত সপ্তাহে সন্ত্রাসবাদের মামলায় অন্তত তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। চলতি বছরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ২১৭ জনের মধ্যে ৯৬ জনই সৌদি নাগরিক। তবে মাদকবিরোধী অভিযানে সৌদি আরবের এই কঠোর অবস্থান কতটা কার্যকর—তা পরিষ্কার নয়।
সূত্র: এএফপি।
এসএস