করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে যখন বেসামাল অবস্থা তখন সেখানে আয়োজিত কুম্ভ মেলায় সমাগম হয়েছিল লাখো মানুষের। এরসঙ্গে ওই মেলায় মানা হয়নি কোনো কোভিড প্রোটোকলও।    

করোনার মধ্যে ওই মেলার আয়োজন নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার এবং উত্তরাখণ্ড সরকারকে। চিকিৎসকদের অনেকের অভিযোগ কুম্ভমেলার ভিড় থেকে উত্তর ভারতে করোনা ছড়িয়েছে। 

এবার সেই কুম্ভমেলা নিয়ে আরও ভয়াবহ তথ্য সামনে এসেছে। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, ওই মেলায় যাওয়া পূণ্যার্থীদের মধ্যে প্রায় এক লাখ টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ টেস্ট না করেই নেগেটিভ রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল।

হিন্দুদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় জমায়েতে হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে আয়োজিত হয় গেল এপ্রিলে। এতে প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট লাখ পুণ্যার্থী জড়ো হন। কিন্তু সেখানে মাস্ক পরা, থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের কোনো বালাই ছিল না। 

সম্প্রতি পাঞ্জাবের এক ব্যক্তির মোবাইলে একটি করোনা টেস্টের রিপোর্ট আসে। মূলত ওই রিপোর্ট থেকেই বেরিয়ে আসে মহা জালিয়াতির এ তথ্য। রিপোর্টটি খুলে ওই ব্যক্তি দেখেন, হরিদ্বার থেকে সেটি এসেছে, যেখানে কুম্ভমেলার আয়োজন হয়েছিল। অথচ পাঞ্জাবের ওই ব্যক্তি কুম্ভে যাননি। করোনার টেস্টও করাননি। ভুয়া রিপোর্টটি নিয়ে তিনি মেডিকেল কাউন্সিলে অভিযোগ করেন। এরপরই শুরু হয় তদন্ত। তদন্তে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। এরকম প্রায় এক লাখ ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে করোনার। 

এপ্রিল মাসের পুরোটা জুড়েই হরিদ্বারে চলেছে কুম্ভমেলার আয়োজন। তবে এর মধ্যে ১২, ১৪ ও ২৭ তারিখ ‘শাহী স্নান’ বা সবচেয়ে পূণ্যের দিন বলে গণ্য করা হয়। ১২ এপ্রিল এ উপলক্ষে হরিদ্বারে ২৮ লাখেরও বেশি ভক্ত গঙ্গায় ডুব দিতে জড়ো হয়েছিলেন।

করোনা মহামারির মধ্যে কুম্ভমেলার আয়োজন নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরে ভারতের আদালত বলেছিলেন, প্রতিদিন অন্তত ৪০ হাজার টেস্ট করতে হবে। সেই মোতাবেক ২২টি এজেন্সিকে টেস্টের দায়িত্ব দেয় কুম্ভমেলা কমিটি। তেমনই একটি এজেন্সি পাঞ্জাবের ওই ব্যক্তির রিপোর্ট পাঠিয়েছিল। 

তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা যায়, একই ফোন নম্বরে, একই ঠিকানায় হাজার হাজার মানুষের নাম এন্ট্রি করা হয়েছিল। সেই জাল রিপোর্ট দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষ কুম্ভে শাহী স্নানে অংশ নেন।
 
করোনায় বিপর্যস্ত ভারতে কুম্ভমেলার আয়োজন নেয় আলোচনা যেমনই চলুক এপ্রিলে উত্তরাখন্ড রাজ্যের পুলিশ প্রধান অশোক কুমার দাবি বলেছিলেন, হরিদ্বারের কুম্ভমেলাকে তারা কোনও ‘সুপার স্প্রেডার ইভেন্ট’ বলে মনে করছেন না।

কুম্ভমেলায় করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতি হয়েছে আরও নানাভাবে। যেমন- ওই একই এজেন্সিতে স্যাম্পেল কালেক্টর হিসেবে যাদের নাম নথিভুক্ত আছে, তারাও কেউ কুম্ভে যাননি। অধিকাংশই রাজস্থানের ছাত্র। তেমনই এক ছাত্র জানিয়েছেন, তিনি কোনোদিন কুম্ভে যাননি। একটি ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ে ভর্তি হয়েছেন রাজস্থানে। সেখানে তার কাছে কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছিল। সেই তথ্যই ওই এজেন্সি ব্যবহার করেছে।

২০২০ সালের মার্চে দিল্লির নিজামুদ্দিনে তাবলীগ জামাতের যে মারকাজে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার মুসল্লি জড়ো হয়েছিলেন, সেটিকে করোনা সংক্রমণের একটি ‘সুপার স্প্রেডার’ ইভেন্ট হিসেবে ভারতের সরকারি কর্মকর্তারাই চিহ্নিত করেছিলেন।

করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির গোটা বিষয়টির পেছনে বিশাল প্রতারণা চক্র কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। উত্তরাখণ্ড সরকার বিশেষ তদন্তের ব্যবস্থা করেছে।

তাবলিগকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর জন্য ঢালাওভাবে দায়ী করা হলেও কুম্ভমেলাকে কেন ছাড় দেওয়া হয়েছে, ভারতে এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেক পর্যবেক্ষক। এর জবাবে উত্তরাখন্ডের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিং রাওয়াত এপ্রিলে বলেছিলেন, দুটোর মধ্যে তুলনা হয় না, কারণ মানুষ এখন জানে নিয়মিত হাত স্যানিটাইজ করতে হবে এবং মাস্ক পরতে হবে। তখন কিন্তু এগুলো জানা ছিল না।

তবে প্রশ্ন উঠছে, সরকারের নাকের ডগায় এত বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটল কী ভাবে? সরকারকে অন্ধকারে রেখে এমন ঘটনা ঘটা কঠিন বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। বস্তুত, কুম্ভ নিয়ে যখন বিতর্ক শুরু হয়েছিল, উত্তরাখণ্ড সরকার তখন স্পষ্টই বলেছিল, কোনোভাবেই মেলা বন্ধ করা হবে না। কেন্দ্রীয় সরকারও একই কথা বলেছিল।  

যে বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা একটি মাত্র কিট থেকে ৭০০ জনের করোনা পরীক্ষা করেছে বলেও দেখানো হয়েছে। 

সূত্র : ডয়েচে ভেলে, বিবিসি ও নিউজএইটিন। 

এনএফ