ইরানের রক্ষণশীল বিচারবিভাগের সাবেক প্রধান বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসিকে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শনিবার দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবারের নির্বাচনে তিনি ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছে। 

ইব্রাহিম রাইসি ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। মাত্র ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইব্রাহিম রাইসি মোট ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪ ভোট পেয়েছেন।

মন্ত্রণালয় বলছে, শুক্রবারের নির্বাচনে ৩৭ লাখ ২৬ হাজার ৮৭০টি ভোট বাতিল হয়েছে; যা ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

রাইসির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৪ লাখ ১২ হাজার ৭১২ ভোট পেয়েছেন ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাবেক কমান্ডার মোহসেন রেজাই। তৃতীয় স্থানে থাকা মধ্যপন্থী আব্দুল নাসের হেমাতি ২৪ লাখ ৭ হাজার ২০১ ভোট পেয়েছেন। এছাড়া রক্ষণশীল প্রার্থী আমির হোসেইন গজিজাদেহ হাশেমী পেয়েছেন ৯ লাখ ৯৯ হাজার ৭১৮ ভোট।

দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল রেজা রহমানি-ফজলি বলেছেন, আমরা এমন কোনও কিছুর লঙ্ঘন করিনি যা নির্বাচনী ফলাফলের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। 

শনিবার নির্বাচনী চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই পরাজয় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন রেজাই, হেমাতি এবং হাশেমী। ইরানের মধ্যপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আগামী আগষ্টের শুরুতে দায়িত্ব নেবেন রাইসি। দেশটির সংবিধানে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধান না থাকায় দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিচ্ছেন হাসান রুহানি। 
 
শনিবার নির্বাচনী ফল ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, আমি জনগণের পছন্দকে স্বাগত জানাই।

ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বলছে, এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি। যদিও দেশটির ভোটার সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৯০ লাখ। রাইসিকে নির্বাচিত করতে সব পরিকল্পনা সাজিয়ে ভোটের আয়োজন করা হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করছেন। তবে নির্বাচনে জয়ের পর সমর্থনের জন্য ইরানিদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাইসি। 

ইরানের চলতি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার আবেদন করেছিলেন প্রায় ৬০০ জন, তাদের মধ্যে ৪০ জন ছিলেন নারী। কিন্তু দেশটির ক্ষমতাসীন কট্টরপন্থী সরকারের প্রভাবশালী সংগঠন গার্ডিয়ান কাউন্সিল রাইসিসহ ৭ জন ছাড়া অন্যান্য সবার প্রার্থিতা বাতিল ঘোষণা করে। এই সাতজনের মধ্যে তিনজন নির্বাচনের আগেই প্রার্থিতার আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত প্রার্থী ছিলেন ওই ৪ জন।

কে এই রাইসি

ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান ৬০ বছর বয়সী রাইসি বর্তমানে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হয়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই সময় হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন রাইসি।

দেশটির সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা খামেনি এবং রাইসির জন্ম একই স্থানে; ইরানের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে। খামেনির মতো না হলেও দেশটির সংখ্যাগুরু শিয়া সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থিমহলে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক।

খামেনির মতো রাইসিরও দাবি, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর রক্তসম্পর্কিত উত্তরাধিকার রয়েছে তার। এ কারণে সবসময় কালো রংয়ের পাগড়ি পরেন তিনি।

তবে ইরানের গণতন্ত্রপন্থী বলয়ে তার জনপ্রিয়তা বেশ কম। কারণ আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থীরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামী কট্টরপন্থী সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেফতার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি।

ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খামেনির আস্থাভাজন হিসেবে হিসেবে উত্থান ঘটে তার। ২০১৯ সালে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দেন খামেনি। ইরানের শিয়া মুসলিমদের কাছে পবিত্র তীর্থ বলে বিবেচিত ইমাম রেজার মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দাতব্য কার্যক্রম ও দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পরিচালনাও করে থাকে এই ফাউন্ডেশন।

তিন বছর মোটামুটি সফলভাবে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেন খামেনি। এ পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ে তার।

রাইসির রাজনৈতিক দর্শন

নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে জাহির করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামী কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের পাশাপাশি  তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক। তবে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বিষয়ে সুর নরম করেছেন তিনি।

দেশের গণতন্ত্রপন্থীদের মতে, যদিও তিনি দুর্নীতি ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইরানের বর্তমান যে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ প্রশাসন, তা গঠনে তার ভূমিকা আছে এবং তিনি নিজেও এই প্রশাসনেরই অংশ।

ইরানের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রেজা ইশরাঘি দেশটির সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘ফরেন রিলেশনস’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাবে।’

এসএস