হ্যালোইনের রঙিন উৎসব বিশ্বজুড়ে–পাতালের দরজা খোলে যে রাতে
ভূতুড়ে পোশাক, মুখে বিচিত্র রঙের আঁকিবুঁকি, হাতে রূপকথার ডাইনি উড়ানো বাহন– ডান্ডিওয়ালা লম্বা ঝাড়ু, মাথায় ছুঁচালো টুপি। এমন সাজে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের দল যখন রাস্তায় নামে, তখন মনে হয় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে কোনো রূপকথার দৃশ্য।
বছরের এই বিশেষ দিনে এটি উৎযাপিত হয়। এদিন সন্ধ্যার পর থেকে গোটা এলাকায় তৈরি হয় গা ছমছমে, রহস্যময় এক পরিবেশ। কেউ সাজায় বাড়ির সামনে প্রাচীন লণ্ঠনের মতো আলো, কেউ আবার মিষ্টিকুমড়া চিড়ে বানায় ভয়াবহ মুখাকৃতি, তার ভেতরে বসানো ছোট্ট আলো মিটমিট করে জ্বলে; সেই আলোয় কেউ ক্যান্ডি সংগ্রহ করে, কেউ আবার পিলে চমকানো হাসিতে ভয় দেখায় অন্যকে।
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমা দেশগুলোতে অক্টোবরের শেষ দিনটিতে পালিত হয় এই হ্যালোইন উৎসব।
বিজ্ঞাপন
শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই এই উৎসব ঘিরে হয় কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য। দেশটির নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে আয়োজিত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যালোইন প্যারেড, যেখানে হাজারো মানুষ অংশ নেন। অনেক দেশে এই দিনটিকে ঘিরে থাকে বড় আলোকসজ্জা, আতশবাজি আর উৎসবের আমেজ। কোথাও কোথাও আবার সরকারি ছুটিও থাকে।
কীভাবে এলো হ্যালোইন উৎসব ?
হ্যালোইন নামটির উৎপত্তি ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে, যা মূলত খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় দিন ‘অল হ্যালোজ ডে’ বা ‘অল সেইন্টস ডে’-এর আগের দিন হিসেবে পালিত হতো।
তবে ইতিহাসবিদদের মতে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে হ্যালোইনের সূচনা হয় ইউরোপের প্রাচীন ধর্মীয় গোষ্ঠী– পেগানদের সামহেইন উৎসব থেকে। পেগানরা প্রকৃতি ও দেবদেবীর উপাসক ছিলেন।
আরেকটি প্রচলিত মত বলছে, এ উৎসবের শিকড় আয়ারল্যান্ডের হেমন্ত ঋতু উদযাপন থেকে এসেছে। তখনকার উদযাপনে আজকের মতো চাকচিক্য ছিল না। ঠিক কোন অঞ্চলে এটি প্রথম শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রাচীন ইউরোপের কেল্টিক গোষ্ঠী-ই সর্বপ্রথম সামহেইন উৎসব পালন করেছিল। কেল্টিকদের বিশ্বাস ছিল, পহেলা নভেম্বর শুরু হয় নতুন বছর। তার আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর রাতে মৃত আত্মারা পৃথিবীতে ফিরে আসে, ঘুরে বেড়ায়, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারে।
তবে সবাই যে এই আত্মাদের আগমনকে সাদরে গ্রহণ করত, তা নয়। আত্মাদের ভয় দেখাতে সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে বড় বড় আগুন জ্বালানো হতো। অনেকে ভূতুড়ে পোশাক পরে ছদ্মবেশ নিতেন, যাতে আত্মারা বুঝতে না পারে তারা জীবিত না মৃত।
যারা এখনো উইচক্র্যাফট বা পেগান ধর্মচর্চা করেন, তাদের কাছে হ্যালোইনের দিনটি এখনো পবিত্র। তাদের বিশ্বাস, এই রাতে মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়।
বিশ্বজুড়ে ৩১ অক্টোবর হ্যালোইন পালিত হলেও এর প্রস্তুতি শুরু হয় অনেক আগেই– কখনো কয়েক সপ্তাহ, আবার কখনো দুই মাস আগে থেকেই। হেমন্তের শুরুতে আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে, রাত দীর্ঘ হয়– তখন থেকেই শুরু হয় উৎসবের আগমনী বার্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে হ্যালোইন এতটাই জনপ্রিয় যে, অনেক রাজ্যে এই দিনে ছুটি থাকে। অক্টোবরের শুরু থেকেই দোকানগুলোতে সাজানো থাকে হ্যালোইনের বিশেষ খাবার, কুমড়া, কস্টিউম আর ভৌতিক সাজসজ্জার সামগ্রী।
গা ছমছমে সন্ধ্যা
হ্যালোইনের রাতে মিষ্টিকুমড়ার ভেতরের অংশ কেটে ফেলে খোদাই করে তৈরি করা হয় ভয়াবহ মুখাবয়ব। তার ভেতরে বসানো হয় ছোট্ট মোমবাতি, যা রাতে বাড়ির সামনে আলো ছড়ায়; একইসঙ্গে ভয় আর সৌন্দর্যের মিশেলে তৈরি করে এক রহস্যময় আবহ।
তবে আয়ারল্যান্ডে যখন এ উৎসবের সূচনা হয়, তখন কুমড়ার পরিবর্তে শালগম ব্যবহার করা হতো।
উনিশ শতকের শুরুতে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে বহু আইরিশ মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। তাদের হাত ধরেই হ্যালোইনের ঐতিহ্য ছড়িয়ে পড়ে নানা দেশে। আমেরিকায় পৌঁছে কুমড়াই হয়ে ওঠে হ্যালোইনের প্রতীক। আজ হ্যালোইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে বাচ্চাদের মুখে উচ্চারিত সেই বিখ্যাত ডাক—‘ট্রিক অর ট্রিট!’ প্রতিবেশীর বাড়ি বাড়ি ঘুরে ক্যান্ডি চাওয়া যেন উৎসবেরই নিয়ম।
ভয়, হাসি আর বিনোদনের রাত
এখন অনেকেই হ্যালোইন উদ্যাপন করেন পরিত্যক্ত বা ভূতুড়ে বাড়িতে– যা ‘হন্টেড হাউস’ নামে পরিচিত। বড়োরা আয়োজন করেন ভূতুড়ে থিমে সাজানো পার্টির, সিনেমা হলে মুক্তি পায় নতুন হরর ছবি।
একসময় আয়ারল্যান্ড ও ব্রিটেনে হ্যালোইনের সময় খেলাধুলা, ভবিষ্যদ্বাণী আর স্বপ্ন বিশ্লেষণের মতো নানা প্রথা ছিল প্রচলিত। পরে চার্চের নির্দেশে রাতভর আগুন জ্বালানো ও ভবিষ্যৎ বলার মতো রীতিগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আসে।
উৎসবটি দিনেদিনে ধর্মীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে নিছক বিনোদন ও আনন্দের দিন। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যান্ডে শুরু হয় ভূতুড়ে পোশাক পরে ঘোরার রীতি, যুক্ত হয় প্র্যাংক বা মানুষকে বোকা বানানোর মজাও। যেখানে ভয়ও পরিণত হয় উৎসবে, আর অন্ধকারে জ্বলে ওঠে আলোর রঙিন মুখোশ।