অনুপ্রবেশকে ইস্যু করে পশ্চিমবঙ্গে জিততে চান অমিত শাহ
তিনদিনের কলকাতা সফরে গিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির শীর্ষ নেতা ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারের সুর বেঁধে দিলেন। পশ্চিমবঙ্গে চলছে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনের প্রক্রিয়া। এই আবহে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোকে ঘিরে জমে উঠেছে অনুপ্রবেশ বিতর্ক।
মঙ্গলবার কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সাংবাদিক বৈঠক করেন শাহ। সেখানে তার মন্তব্য, ‘‘আমি নিশ্চিত, আগামী নির্বাচন অনুপ্রবেশকারীদের তাড়ানো এবং অনুপ্রবেশ ঠেকানোর ইস্যুতে হবে।’’
বিজ্ঞাপন
অনুপ্রবেশের জন্য পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল বারবার বিএসএফের দিকে আঙুল তোলে। এর জবাবে শাহ বলেছেন, আমি এই সাংবাদিক বৈঠক থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চাই, এমন কোনো রাজ্য সরকার আছে, যারা সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়ার জন্য বিএসএফকে জমি দিচ্ছে না? একটাই উত্তর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
অনুপ্রবেশের জন্য সরাসরি তৃণমূলকে দায়ী করেন শাহ। তিনি বলেন, বাংলায় অনুপ্রবেশ হয় তৃণমূল সরকারের মদতে। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলার জনবিন্যাস পাল্টে আপনি নিজের ভোটব্যাঙ্ক পোক্ত করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা বেশি দিন চলবে না। বাংলার মানুষ এর বিরুদ্ধে জোট বাঁধছে।
বিজ্ঞাপন
রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে দেশটির এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বর্ডার টপকে অনুপ্রবেশকারীরা প্রথমে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আশ্রয় নেয়। আপনার পুলিশ কী করছে? কেন তাদের গ্রেপ্তার করা হয় না? আসাম, ত্রিপুরায় অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়েছে। বাংলায় কেন হল না, তার জবাব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিতে হবে।
তার দাবি, রাজ্যের মানুষ অনুপ্রবেশের সমস্যায় অতিষ্ঠ। গোটা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে পড়েছে। এর জবাব পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ভোটের সময়ে দিতে হবে।
• মতুয়াদের আশ্বাস
এসআইআরের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের পরই দেখা গিয়েছে নাম নেই বহু মতুয়ার। নাগরিকত্ব নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তারা। আন্দোলন শুরু করেছেন মতুয়াদের একাংশ। তাদের নিশ্চিন্ত করতে শাহ কী বলেন, সেদিকে নজর ছিল।
অমিত শাহ বলেন, মতুয়াদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। কেউ তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। যারা শরণার্থী হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসেছে, তাদের সকলকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গের জনতা ত্রস্ত। রোজভ্যালি চিটফান্ড, ক্যাশ ফর কোয়্যারি, এসএসসি, পুর নিয়োগ, গরু পাচার, রেশন, ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতি—এত দুর্নীতি রয়েছে গোটা তালিকা বলতে গেলে পুরো সাংবাদিক বৈঠকই কেটে যাবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি উত্তর দিতে পারবেন? আপনার মন্ত্রীর ঠিকানা থেকে ২৭ কোটি টাকা পাওয়া যায়। যা গুনতে গুনতে নোট গোনার মেশিনও গরম হয়ে যায়।
• তৃণমূলের জবাব
বাঁকুড়ার বড়জোড়ার জনসভা থেকে কাশ্মিরের পেহেলগামের জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ টেনে শাহকে জবাব দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, অনুপ্রবেশকারী শুধু বাংলাতেই? কাশ্মিরে নাকি নেই! পেহেলগামে আপনারা কী করলেন? দিল্লিতে বিস্ফোরণের কথা ভুলে গেলেন? যত দোষ বাংলার? এরা (বিজেপি) রাজনৈতিক হ্যাংলার দল।
মমতার দাবি, সীমান্তে জমি সংক্রান্ত কেন্দ্রের অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেন্দ্রীয় সরকারকে জমি দেয়ার খতিয়ান তুলে ধরে মমতা বলেন, আমি জমি না দিলে কয়লা তোলার জন্য ইসিএল কোথা থেকে জমি পেত? রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, বাঁকুড়ায় জমি কে দিয়েছে? বনগাঁয় পেট্রাপোলের জমিই বা কে দিয়েছে? এখন বড় বড় কথা বলছে! সব মিথ্যে কথা।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিল্লি রওনা হওয়ার আগে কলকাতা বিমানবন্দরে বলেন, দেশের সর্বকালের ব্যর্থতম এবং অপদার্থতম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম অমিত শাহ। অনুপ্রবেশ হয়ে থাকলে সবার আগে ওরই পদত্যাগ করা উচিত।
তার কটাক্ষ, বিশেষ নিবিড় সংশোধনে কতজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীর নাম বাদ গিয়েছে, সেটা এখনো বলতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। তাই হয়তো এ দিন অমিত শাহের মুখে একবারও রোহিঙ্গা শব্দটি শোনা যায়নি।
দুর্নীতির প্রসঙ্গে মমতা বলেন, আমাদের নেতারা দুর্নীতি করলে ব্যবস্থা নাও। আমাদের চার জনকে ধরেছিলে। জেলে রাখতে পেরেছ? পারোনি। আর তোমাদের খুন-ধর্ষণ করা লোককে ছেড়ে দিচ্ছ।
• অনন্ত অস্বস্তি
বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ অনুপ্রবেশ ইস্যুতে সরাসরি দেশের প্রধানমন্ত্রীকেই নিশানা করেছিলেন দু’দিন আগে। রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার দাবি করেছিলেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়া হবে।
এই প্রসঙ্গ টেনে অভিষেকের বক্তব্য, অমিত শাহকে অনুরোধ করব, তাদের দলের সাংসদ অনন্ত মহারাজ, জগন্নাথ সরকাররা যা বলেছেন, সেটা মন দিয়ে শুনতে। বিজেপি কি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? শো-কজ করেছে? সাসপেন্ড করেছে?
• বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
অনুপ্রবেশের ইস্যুকে আরও জোরালোভাবে সামনে আনার চেষ্টা করলেও, অমিত শাহরা এ থেকে কতটা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারবেন? সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, অনুপ্রবেশ এবং এসআইআর ইস্যুকে যেভাবে বিজেপি মেলাতে চেয়েছে, তাতে তাদের অবস্থান বরং দুর্বল হয়েছে। এসআইআর থেকে কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মতুয়াদের সমস্যা বা নাম কাটা যাওয়ার কারণে বিজেপির খুব একটা ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না, কারণ মানুষ অনেকগুলো দিক বিচার করে ভোট দেয়।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনে দুর্নীতি এখন আর বড় ফ্যাক্টর হচ্ছে না। এছাড়া বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ (যেমন গুজরাটে ব্রিজ ভেঙে পড়া) এবং অন্য দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের দলে নেয়ার কারণে তাদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির কথা বলে তারা বাড়তি সুবিধা পাবে বলে মনে হয় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, অমিত শাহর এই সফরটা তো মূলত ভোট প্রচারের জন্য। তিনি এখানে এসে যে সমস্ত কথা বলেছেন তার মধ্যে দুটি প্রধান ইস্যু আছে। একটা হচ্ছে অনুপ্রবেশ এবং নাগরিকত্ব ইস্যু, আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে এই রাজ্যের দুর্নীতি।
তিনি বলেন, অনুপ্রবেশের কথা বিজেপি অনেকদিন ধরেই বলছে। কিন্তু এইবার যেভাবে বিষয়টাকে এনআরসি এবং সিএএর সাথে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে মানুষের মনে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভয়টা কাজ করছে যে, নাগরিকত্ব পাওয়ার বদলে নাগরিকত্ব চলে যাবে কি না। এটা বিজেপিকে খুব একটা সুবিধা দেবে বলে মনে হয় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, মতুয়ারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে এলেও অনেকেই সঠিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকত্ব পাননি। অনেকে অবৈধভাবে ভোটার তালিকায় নাম তুললেও যারা তা করেননি, তারা এখনো নাগরিকত্বহীন অবস্থায় আছেন। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান নির্দেশ অনুযায়ী, যথাযথ নাগরিকত্ব ছাড়া ভোট দেওয়া সম্ভব নয় এবং কোনো বিশেষ চিরকুটে এই সমস্যার সমাধান হবে না। ডি ডাব্লিউ।
এসএস