বুধবার বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়িস।

১৮০৪ সালে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের প্রথম স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় হাইতি। দেশটি প্রথমে স্পেনীয় ও পরে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। ফরাসি ঔপনিবেশিকদের উৎখাত করে বিশ্বে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নেতৃত্বাধীন সরকার গঠিত হয়। 

স্বাধীন হলেও বিগত দুই শতাব্দী ধরে দেশটি একের পর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা, আগ্রাসন আর দমনপীড়নের মধ্য দিয়ে গেছে। এর মধ্যে পরিবারতান্ত্রিক দুভেলিয়ারদের স্বৈরতান্ত্রিক কর্তৃত্বাবাদী শাসনের শিকার হয়েছে দেশটির মানুষ।  

গতকাল বুধবার ব্যক্তিগত বাসভবনে কয়েকজন অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে হাইতির প্রেসিডেন্ট জোভেনেল ময়িস নিহত হওয়ার পর ফের অস্থিরতার শঙ্কা মাথাচাড়া দিয়েছে। হাইতির অস্থিরতা ও সহিংসতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এখানে তুলে ধরা হলো।

১৪৯২

ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর হিসপানিওলা দ্বীপকে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে নেয় স্পেন। দুইশ বছর পর স্পেন দ্বীপের পশ্চিম অংশ দেয় ফ্রান্সকে। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দাসদের উৎপাদিত চিনি, রাম ও কফিতে সমৃদ্ধ হয় ফ্রান্স।

১৮০১

তৌসাইন্ট ল্যুভেরচারের নেতৃত্বে একটি সফল বিদ্রোহ সংঘঠিত হয় এবং অবসান ঘটে দাস ব্যবস্থার।  

১৮০৪

এক সময়ের দাস জ্যাঁ জ্যাকস দেসালিনেসের অধীনে স্বাধীন হয় হাইতি। ১৮০৬ সালে দেসালিনেস হত্যার শিকার হন।

১৯১৫

হাইতিতে আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৩ সালে হাইতি ছাড়লেও দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখনো বিদ্যমান রয়েছে। 

১৯৩৭

এই বছর সবচেয়ে খারপ ঘটনাটি ঘটে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে এই বছর  হাইতি সীমান্তে হাজারো মানুষকে হত্যা করে ডমিনিকান সেনারা। এই গণহত্যার নির্দেশ দেন দেশটির স্বৈরশাসক ট্রুজিল্লো।   

১৯৫৭

সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন ফ্রাঙ্কোইস ‘‘পাপা ডক’’ ডুভেলিয়ার। এর মধ্যে দিয়ে হাইতি এমন এক যুগের গোড়াপত্তন ঘটে যেই সময়ে দেশটিতে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে।   

১৯৬৪ 

ডুভেলিয়ার নিজেকে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। তার কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসনামলে টনটন ম্যাকাউটিস নামে এক গোপন পুলিশ বাহিনী দেশটির মানুষের ওপর নানাভাবে দমনপীড় চালায়।   

১৯৭১

ডুভেলিয়ার মারা যান এবং ক্ষমতায় বসে তার ছেলে জ্যা ক্লদ। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে যিনি ‘‘বেবি ডক’’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরের কয়েক দশকে হাইতির ‘‘বোট পিপল’’ সাগর পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পালাতে থাকে। অনেকের মৃত্যু হয় যাত্রাপথে।   

১৯৮৬

সামরিক অভ্যুত্থান হলে বেবি ডক দেশ থেকে পালিয়ে ফ্রান্সে গিয়ে আশ্রয় নেন। রাষ্ট্রক্ষমতা নিজের দখলে নেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নামফি। 

১৯৮৮

আবারও এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নামফিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নামফিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল প্রসপার আভরিল। 

১৯৯০

বিক্ষোভের মুখে আভরিল জরুরি অবস্থা জারি করলেও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করেন। প্রান্তিক মানুষের পক্ষে কাজ করে পরিচিত বামপন্থী ও সাবেক প্যারিশ পুরোহিত জ্যাঁ বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইড হাইতির প্রথম অবাধ নির্বাচনে জয়ী হন। 

১৯৯১

নির্বাচনের এক বছরের মাথায় আবারও সামরিক অভ্যুত্থান হয়। ওই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন নির্বাচিত নেতা বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইড।

১৯৯৪

সামরিক জান্তা সরকারকে উৎখাত করে বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইডকে ক্ষমতায় ফেরাতে হাইতিতে সামরিক অভিযান চালায় মার্কিন সেনারা।  

১৯৯৫

হাইতিতে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে জাতিসংঘ এবং অ্যারিস্টেইড সমর্থিত রেনে প্রেভাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 

১৯৯৯

দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইড। তবে ওই নির্বাচন নিয়ে ফল জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল। 

২০০৪

রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে বাধ্য হয়ে বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইড দেশ ছেড়ে পালান কিন্তু ব্যাপক সহিংসতার মুখে পড়ে হাইতি। 

২০০৬

বাট্রান্ড অ্যারিস্টেইডের এক সময়ের অনুসারী রেনে প্রেভাল নির্বাচনে জয় পান।

২০০৮-২০১০

আগে থেকে বিদ্যমান খাদ্য সংকট, কলেরা মহামারি আর এরপর নির্বাচন নিয়ে একের পর এক বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করতে থাকে হাইতি। 

২০১০

ভয়াবহ এক ভূমিকম্পে তিন লাখ মানুষ মারা যায়। পোর্ট অ প্রিন্স ও অন্য অঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আন্তর্জাতিক ত্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকট প্রকট হতে শুরু করে।

২০১১ 

মাইকেল মারতেল্লি দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। 

২০১২-১৪

এই সময়কালে দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ লেগেই ছিল হাইতিতে। ক্ষুব্ধ মানুষ প্রেসিডেন্ট মারতেল্লির পদত্যাগ দাবি করেন।  

২০১৭

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হিসেবে কলা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ হওয়া জোভেনেল ময়িসের নাম ঘোষণা করা হয়।  

২০১৯

রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতার ফলে নির্বাচন করতে ব্যর্থতার পর ময়িস অবিচলভাবে ডিক্রি দিয়ে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করেন। তার পদত্যাগ দাবিতে মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়ে ‌‘স্বৈরশাসন মানি না’ স্লোগান দেন। বুধবার সেই ময়িসও হত্যার শিকার হলেন। 

এএস