উইঘুর ইস্যুতে সম্প্রতি চীনের ১০ কোম্পানিকে কালো তালিকায় ফেলার পর এবার একই ইস্যুতে চীনের জিনজিয়াং থেকে পণ্য আমদানি নিষিদ্ধে বিল পাস করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট।

সিনেটের রিপাবলিকানপন্থি সদস্য মার্কো রুবিও এবং ডেমোক্যাটপন্থি সদস্য জেফ মার্কলে যৌথভাবে এ সংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপন করেছিলেন। বুধবার কংগ্রেসের উচ্চকক্ষের উপস্থিত সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হয়।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে মার্কো রুবিও বলেন, ‘চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর ও সংখ্যালঘু অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যেভাবে লাগাতার মানবতাবিরোধী ভয়াবহ সব অপরাধ সংঘটিত করছে, আমরা সে বিষয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।’

‘জিনজিয়াং এর পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ দেওয়ার অর্থ- চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যাবতীয় বর্বর আচরণকে বৈধতা দেওয়া। জিনজিয়াংয়ে উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়কে দাসের মতো বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং সেখানকার যেসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছে, সেগুলোতে উইঘুর ও সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর রক্ত মিশে আছে।’

‘যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, নৈতিকতা ও বিবেকের দৃষ্টিকোণ থেকে একদিকে যেমন কোনো মার্কিন কোম্পানির এসব পণ্যের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়, তেমনি মার্কিন নাগরিকদেরও এসব পণ্য ভোগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।’

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টারি প্রথা অনুযায়ী, সিনেটে পাস হওয়া এই বিল এখন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসে পাঠানো হবে। সেখানে পাস হলে তা পাঠানো হবে হোয়াইট হাউসে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের স্বাক্ষরের জন্য। প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করলেই আইনে পরিণত হবে বিলটি।

সিনেটের একাধিক সদস্য আশা করছেন, নিম্নকক্ষেও দ্রুত সর্বসম্মতি ক্রমে পাস হবে এই বিল।

জিনজিয়াংয়ের কয়েকটি পণ্য আমদানিতে আগেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল মার্কিন সরকার। সেই পণ্যসমূহ হলো শাক-সবজি, তুলা এবং সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রাংশ। সিনেটে সম্প্রতি পাস হওয়া বিলটি আইনে পরিণত হলে জিনজিয়াং থেকে যাবতীয় পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ হবে যুক্তরাষ্ট্রে।

এর আগে গত ৯ জুলাই চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বিপুলসংখ্যক সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমকে বন্দি রেখে নির্যাতন-গণহত্যা-ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চীনের ১০টি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

উইঘুর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমল থেকে। ২০১৯ সালে ৮ টি প্রযুক্তিভিত্তিক চীনা কোম্পানিকে কালো তালিকায় ফেলেছিল ট্রাম্প প্রশাসন।

গত কয়েক বছর ধরে জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের বন্দিশিবিরে রাখার পাশাপাশি তাদের গণহত্যা, বাধ্যতামূলক শ্রমদান এবং উইঘুর নারীদের ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পম্পেও সর্বপ্রথম চীনের বিরুদ্ধে জিনজিয়াংয়ে গণহত্যার অভিযোগ তুলেছিলেন। গত বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন- উইঘুর মুসলিমদের গণহারে হত্যা করছে চীন।

তার এই বক্তব্যের জেরে পম্পেও এবং বেশ কয়েকজন মার্কিন প্রশাসনিক কর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার; এবং তা এখনও বহাল আছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসমূহের অভিযোগ, চীনের ক্ষমতাসীন সরকার জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় দশ লাখ উইঘুর মুসলিমকে ২০১৬ সাল থেকে একটি ক্যাম্পে বন্দি করে রেখেছে। তাদের ধর্মের অধিকার, সন্তান উৎপাদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে কার্যত দাসের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে;  যদিও এসব অভিযোগ কখনোই মানতে চায়নি চীন।

তবে চীন না মানলেও জিনজিয়াংয়ের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়া উইঘুররা ভয়াবহ অত্যাচারের কথা বলেছেন।

জিনজিয়াংয়ে দেশি-বিদেশি কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা পর্যবেক্ষক দলকে এখন পর্যন্ত যেতে দেয়নি চীনের ক্ষমতাসীন সরকার; ফলে জিনজিয়াঙে আসলে কী ঘটছে তা এখনও বিশ্বাবাসীর কাছে অস্পষ্ট।

বিবিসির এক অনুসন্ধানে উইঘুরদের জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ক্যাম্পের রক্ষী ও কর্মকর্তারা উইঘুর নারীদের নিয়মিত ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করছেন বলেও উঠে আসে ওই অনুসন্ধানে। চীনের সরকার অবশ্য এই প্রতিবেদন খারিজ করে দিয়েছে।

এ বিষয়ে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিবিসির ওই প্রতিবেদন ‘মনগড়া’ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে লেখা।

উইঘুর মুসলিমদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আদালতেও একটি পিটিশন জমা পড়েছিল। কিন্তু বিচারপতিরা সেই আবেদন গ্রহণ করেননি। না করার কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছিলেন, চীন যেহেতু আদালতে আসবে না, ফলে এই অভিযোগের বিচার করা সম্ভব নয়।

সূত্র : রয়টার্স

এসএমডব্লিউ