কৃষি সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ করছেন ভারতের হাজার হাজার কৃষক

কৃষি সংস্কার আইন ঘিরে ভারতে কয়েকমাস ধরে চলমান কৃষক আন্দোলনে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি। কৃষকরা রাজধানীতে প্রবেশের সব পথ অবরুদ্ধ করে রাখায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার কর্তৃত্ব এবং কৃষি আইন সংস্কার নিয়ে কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
 
দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে কৃষকদের আন্দোলন তৃতীয় সপ্তাহ পাড় করছে। নতুন কৃষি আইনের নেপথ্যের গল্প, কৃষকদের বিরোধিতা এবং এই সঙ্কট মোকাবিলায় নরেন্দ্র মোদির সীমিত সক্ষমতা উঠে এসেছে ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে।
 
ভারতে কৃষি খাতের চিত্র

ভারতের কৃষি খাত বিশাল এবং সমস্যায় জর্জরিত। ১৩০ কোটিরও বেশি মানুষের এই দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশই কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশটির ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান অর্থনীতিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ।

নিয়মিত খাদ্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা একটি দেশ ‌সত্তর দশকের সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে বদলে যায়; এই অঞ্চলের খাদ্যের উদ্বৃত্ত ও প্রধান রফতানিকারক দেশে পরিণত হয় ভারত। কিন্তু গত কয়েক দশকে দেশটির কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আয় প্রায় থমকে গেছে। এই খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ এবং আধুনিকায়ন প্রয়োজন।

ভারতের কৃষি মন্ত্রণালয়ের ২০১৫-১৬ সালের এক জরিপের তথ্য বলছে, দেশটির ৮৫ শতাংশের বেশি কৃষকের মালিকানা রয়েছে দুই হেক্টরেরও কম জমির। একশ জনের মধ্যে একজনেরও কম কৃষক ১০ হেক্টরের বেশি জমির মালিক। 

সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন কৃষকরা

দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, প্রত্যেক বছর প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি মার্কিন ডলার ভর্তুকি পেয়ে থাকেন কৃষকরা। 

কৃষকদের লড়াই

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সঙ্কট, বন্যা ও ক্রমবর্ধমান বৈরী আবহাওয়ার পাশাপাশি ঋণের চরম মাশুল গুণতে হচ্ছে ভারতের কৃষকদের। পাঞ্জাব সরকারের ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩৯ সালের মধ্যে উত্তরাঞ্চলীয় এই রাজ্যের ভূগর্ভস্থ সব পানি ফুরিয়ে যাবে।

নব্বইয়ের দশক থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে তিন লাখের বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দেশটির সর্বশেষ সরকারি তথ্য বলছে, শুধুমাত্র গত বছরেই ভারতে ১০ হাজার ৩০০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। বর্তমানে দেশটির অনেক মানুষ কৃষি ছেড়ে অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন।

ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারির তথ্য বলছে, দেশটিতে দিনে গড়ে অন্তত দুই হাজার মানুষ কৃষি পেশা ত্যাগ করছেন।
 

মোদির অঙ্গীকার 

ভারতের নির্বাচনী ময়দানে গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয় কৃষি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। নির্বাচনের আগে এই কৃষকদের ভাগ্য ও কৃষির উন্নয়নে নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এর ব্যতিক্রম নন; ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

গত সেপ্টেম্বরে ভারতের পার্লামেন্টে অন্তত তিনটি আইন পাস হয়। এসব আইনে কৃষকরা রাজ্য-নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলোর পরিবর্তে তাদের পছন্দের ক্রেতার কাছে পণ্য বিক্রি করতে পারবেন বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু দেশটির কৃষকরা বলছেন, নতুন কৃষি সংস্কার আইনের ফলে তাদেরকে ফসল বিক্রির জন্য বেসরকারি ক্রেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করতে হবে। 

কৃষক শোষণ ঠেকাতে ১৯৫০ এর দশকের দিকে ভারতে রাজ্য-নিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা চালু করা হয়। এই বাজারের মাধ্যমে কৃষকদের নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদনের জন্য সর্বনিম্ন সহায়ক মূল্য (এমএসপি) আগাম দেয়া হয়। তবে দেশটির কৃষকরা এই ব্যবস্থায় প্রায়ই দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন।

কিন্তু দেশটির অনেক কৃষক এমএসপিকে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে দেখেন। তাদের আশঙ্কা নতুন আইনগুলোর ফলে বৃহৎ কৃষি ফার্মগুলোর সঙ্গে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। এমনকি বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি পণ্যের মূল্য নিজেদের ইচ্ছে মতো নির্ধারণ করতে পারেন।  

৪০০ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে রাজধানী নয়াদিল্লির কৃষক আন্দোলনে যোগ দেয়া কৃষি কর্মী সুখীন্দর সিং বলেন, আইনগুলো কৃষকদের ক্ষতি করবে এবং আমাদের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হবে।

তিনি বলেন, ‘ভূমি, গবাদি পশু এবং কৃষকরা ধনাঢ্যদের দাসত্ব করবে। সরকার আমাদের শেষ করে দিতে চায়।’ 

কী করবেন মোদি?
 
২০১৬ সালে পুরোনো ব্যাঙ্ক নোট বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর দেশটিতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু এই সমালোচনা তার জনপ্রিয়তার নিচে চাপা পড়ে যায়। ২০১৯ সালে দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস জয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসেন তিনি। 

নরেন্দ্র মোদির কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার দেশটিতে বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন পাসের পর টানা কয়েক মাস সহিংস বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এই আইন দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদের জন্য বৈষম্যমূলক বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা।

কৃষি সংস্কার আইন ঘিরে গড়ে ওঠা আন্দোলনে সুযোগসন্ধানী বিরোধীরা কৃষকদের ভিন্নপথে চালিত করছে বলে অভিযোগ করেছেন ৭০ বছর বয়সী নরেন্দ্র মোদি। বিজেপির অনেক নেতা আন্দোলন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে কৃষকদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছেন। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই শিখ ধর্মের অনুসারী হওয়ায় তাদেরকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং জাতীয়তাবিরোধী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন তারা। 

কিন্তু কৃষকদের আন্দোলনে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এই আন্দোলনে দেশজুড়ে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছেন কৃষকরা। দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসরত ৭০ শতাংশ ভারতীয়র মধ্যে ক্রমবর্ধমান ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বড় বড় ব্যবসায়ী ও এশিয়ার শীর্ষ ধনি মুকেশ আম্বানির মতা শিল্পপতিদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাদের স্বার্থ গুরুত্ব দিয়ে নতুন নতুন আইন তৈরি করছেন তিনি।

ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরতি জেরাথ ফরাসী বার্তাসংস্থা এএফপিকে বলেন, কৃষি খাতে এমন অনেক বিষয় রয়েছে; যেগুলো মান্ধাতার আমলের। কিন্তু সংস্কারের মাধ্যমে এসব বিষয় বদলে ফেলা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, এটাই এখন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পিছু ফেরার জন্য সঠিক উপায় খুঁজে বের করতে হবে। একই সময়ে এই সঙ্কটের সমাধানও করতে হবে।

সূত্র : এএফপি, আলজাজিরা।

এসএস