ভারতীয় অভিনেত্রী এবং টিভি উপস্থাপিকা মন্দিরা বেদী তার স্বামীর সৎকারের কাজ করায় খবরের শিরোনামে এসেছেন। ভারতে প্রথাগতভাবে মৃতদেহের সৎকারের সব কাজ করে পুরুষ। নারীদের এমনকি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেও নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এর পেছনে কী বিশেষ কোনো কারণ রয়েছে? হিন্দু নারীদের জন্য সৎকারের কাজ কি ধর্মে মানা?

মন্দিরা বেদী এক হাতে মাটির পাত্র আর অন্য হাতে স্বামীর মরদেহ বহনকারী বাঁশের খাট বহন করে কাঁদতে কাঁদতে শ্মশানে যাচ্ছেন, এটা ভারতীয় সমাজে বেশ বিরল একটি দৃশ্য। স্বামী রাজ কৌশলকে চিতায় তোলার পর তার মুখাগ্নিও করেছেন মন্দিরা বেদী।

তার স্বামী ৪৯ বছর বয়সী চিত্রনির্মাতা রাজ কৌশল গত ৩০ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে প্রথা ভেঙে এভাবে স্বামীর সৎকারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেবার জন্য অনেকেই অভিনেত্রী মন্দিরা বেদীকে প্রশংসা বার্তা পাঠিয়েছেন। তার শোকের মধ্যেও হিন্দুদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ নিয়ে পত্রপত্রিকায় মন্তব্যও করছেন অনেকে।

জনপ্রিয় লেখিকা ও কলামিস্ট শোভা দে লিখেছেন, ‘শোকাভিভূত মন্দিরা তার স্বামীর সৎকার করছেন; এই দৃশ্য আমাদের সমাজের শতাব্দী প্রাচীন সংস্কারের বিরুদ্ধে একটা চ্যালেঞ্জ। তার এই সিদ্ধান্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী বার্তা দেবে।’

তিনি আরও বলছেন, ‘মন্দিরা বেদী যখন এ সপ্তাহে তার স্বামীর চিতায় আগুন জ্বালান, তখন তিনি বুঝতেও পারেননি অজান্তেই তিনি আগুন জ্বালিয়েছেন অনেক নরনারীর মনের ভেতরেও, যারা এই প্রথায় অবিশ্বাসী, কিন্তু শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেতে তারা কখনও সাহস পাননি। এই চিতার আগুন সেই শৃঙ্খল ভাঙার আগুন হয়ে উঠবে।’

তবে মন্দিরা বেদী একমাত্র নারী নন যিনি প্রিয়জনের সৎকারের কাজ করেছেন। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন ২০১৮ সালের আগস্টে মারা যান, তখন তার পালিতা কন্যা নমিতা কউল ভট্টাচার্য তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন। এমনকি মহারাষ্ট্র রাজ্যের একজন ঊর্ধ্বতন বিজেপি নেতা গোপীনাথ মুণ্ডের কন্যা পঙ্কজা মুণ্ডেও ২০১৪ সালে তার বাবার চিতায় মুখাগ্নি করেছিলেন।

সাম্প্রতিক মহামারির সময়ও অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির সৎকার করতে দেখা গেছে তাদের স্ত্রী বা কন্যাদের। তবে সেসব ক্ষেত্রে কারণ ছিল হয়ত সেসব পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সবাই মারা গেছেন, নয়তো কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন অথবা লকাডাউনে চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধের কারণে মৃতের সৎকার করতে অন্য এলাকায় যেতে পারছেন না।

তবে মন্দিরা বেদীর এই প্রথা ভাঙায় সন্তুষ্ট নয় ভারতীয় সমাজের রক্ষণশীলরা। সামাজিক মাধ্যমে ডানপন্থীরা তাকে নানভাবে ট্রল করছে- কেউ কটূ মন্তব্য করছে, কেউ তাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। যারা তাকে হেনস্থা করছে তাদের বক্তব্য- কেন তাদের দশ বছরের ছেলেই তো বাবার চিতায় আগুন দিতে পারত? কেউ কেউ আবার মনে করিয়ে দিতে ছাড়েনি যে ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিতে একজন নারীর শ্মশানে যাওয়াও উচিত নয়।

ধর্মীয় ব্যাখ্যা কী?
কিছু হিন্দু পুরোহিত এবং ধর্ম বিষয়ক শিক্ষাবিদ বিবিসিকে বলেছেন, হিন্দু ধর্ম শাস্ত্রে নারীদের শ্মশানে যাওয়া বা তাদের প্রিয়জনের শেষ কাজ করা বা চিতায় আগুন দেওয়া নিষিদ্ধ নয়। তাহলে নারীদের কেন শ্মশানে যেতে বাধা দেওয়া হয়? কেন তাদের প্রিয়জনের শেষকৃত্য করতে দেওয়া সমাজবিরুদ্ধ?

ইন্টারনেটে এর উদ্ভট সব কারণ ব্যাখ্যা করা আছে। এর মধ্যে একটা কারণ হিসাবে বলা হয়েছে- ‘নারীদের যেহেতু লম্বা কালো চুল থাকে তাই নারীরা শ্মশানে গেলে সেখানে ঘুরে বেড়ানো অশরীরী প্রেতাত্মারা নারীদের ঘাড়ে সহজেই ভর করে।’

অশরীরী জিন-ভূত ভর করার জন্য নারীদের শরীরকেই বেছে নেয় এমন একটা ধারণা বহুদিন ধরেই প্রচলিত রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে। কিন্তু উত্তরাঞ্চলীয় মির্জাপুর শহরে অবসরপ্রাপ্ত সংস্কৃতের অধ্যাপক ভাগওয়ান দাত্ পাঠক বলছেন, এর পেছনে কারণটা সম্ভবত সামাজিক। ভারতীয় সমাজে নারীরা একসময় মূলত ঘরেই থাকতেন, সংসার দেখতেন। বাইরের কাজ করতেন পুরুষরা। ভারী জিনিস তোলার কাজগুলো পুরুষরাই করতেন।

সুপরিচিত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক কৌশলেন্দ্র পাণ্ডে আবার বলছেন, ভারতীয় পুরাণে এমন উল্লেখ রয়েছে যে, যখন কোনো পরিবারে একজন পুরুষ মারা গেছেন, যিনি নিঃসন্তান অথবা তার কোনো ভাই নেই, সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী স্বামীর সৎকার করেছেন। তিনি বলছেন, এমনকি কন্যা সন্তানেরও পিতার শেষকৃত্য করা ধর্মীয় বিধিসম্মত।

ভারতীয় পুরাণ থেকে এই বিধি?
মনোজ কুমার পাণ্ডে একজন শেষকৃত্য বিশারদ। তিনি বলছেন, মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য যে সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র সন্তানকে করতে হবে এটা এসেছে ভারতীয় পুরাণ থেকে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পুরাণের যে অংশে শেষকৃত্য নিয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে তা অন্তত এক হাজার বছরের পুরনো। এই পুরাণ কিন্তু শেষকৃত্যে নারীর ভূমিকা নিয়ে নীরব। তবে শেষকৃত্যের অধিকার যে নারীর নেই সে কথাও ধর্ম গ্রন্থে বলা নেই।

অধ্যাপক পাণ্ডে বলছেন, মন্দিরা বেদীর জন্য স্বামীর সৎকার করার সিদ্ধান্ত ‘সঠিক’ ছিল। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে- স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক খুবই গভীর ছিল। তিনি তার ছেলেকে রক্ষাও করতে চেয়েছেন, কারণ তাদের ছেলে খুবই ছোট। তিনি খুবই সম্মানিত একজন নারী এবং আমার বিশ্বাস তিনি যা করেছেন, ঠিকই করেছেন।

তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, অনেক নারী শ্মশানে যান না, তাদের নিজস্ব কারণে। কারণ নারীরা সৎকারের আচার অনুষ্ঠান হয়তো সহ্য করতে পারেন না কারণ তারা ‘দুর্বল ও নরম’ মনের- তার এই যুক্তি বহু নারী প্রত্যাখান করেন।

ব্যক্তিগত বিশ্বাস
সংবাদ ওয়েবসাইট দ্য প্রিন্ট-এর সম্পাদকীয় উপদেষ্টা শৈলজা বাজপেয়ী বলছেন, ভারতের ছোট ছোট শহর বা গ্রামে-গঞ্জে নারীরা সচরাচর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন না। কিন্তু শহরগুলোতে ক্রমশ নারীদের এখন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা যাচ্ছে।

বাজপেয়ী বলছেন, তিনি নিজেই বেশ কয়েকটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শ্মশানে গেছেন। নিজের বাবা মায়ের সৎকারের সময়ও তিনি শ্মশানে গিয়েছিলেন।

তার দাবি, ‘আমি যাই কারণ আমি মৃত ব্যক্তিকে শেষ বিদায় জানাতে চাই। আমার কাছে মনে হয় আমার প্রিয় জনকে শেষ বিদায় জানালে আমি মানসিকভাবে শান্তি পাব। আমার জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার পরিবারের অন্য নারী সদস্যরা যান না।’

‘নারীদের শ্মশানে যেতে নেই, সৎকারের কাজ করতে নেই- এটা বহু দিনের একটা সংস্কার। আমাদের পরিবারের বহু নারী কখনও এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। আমি তাদের এই বিশ্বাসকে সম্মান করি।’

বাজপেয়ী বলছেন, এটা আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। এর প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। যে যেটা করতে চায়, তাকে সেটাই করতে দেওয়া উচিত।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম