আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের সাহায্য করার জন্য তালেবানের হাতে জীবন বিপন্ন হতে পারে এমন বেশ কিছু আফগান দোভাষী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরকম ২২১ জনের একটি দল কাবুল থেকে একটি ভাড়া করা বিমানে শুক্রবার ভোরে ওয়াশিংটনের ডালাস বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

এরপরই তাদের সেখান থেকে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় ১৩০ মাইল দূরে ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যে ফোর্ট লি সেনা ঘাঁটিতে। বাসস্থানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই একটি হোটেলে আপাতত কড়া নিরাপত্তার ভেতরে থাকবেন তারা।

আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর দোভাষী হিসাবে বা অন্যান্য সহকারীর ভূমিকায় কাজ করা ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ২ হাজার ৫০০ জনকে জরুরী ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে উড়িয়ে এনে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার ওয়াশিংটনে এসে নামা ওই ২২১ জন তাদেরই প্রথম দল। এই দলে রয়েছে ৫৭টি শিশু এবং ১৫টি অল্প বয়সী বাচ্চা।

জানা গেছে, বাকিদের আনতে প্রতি তিন-চার দিন অন্তর অন্তর কাবুল থেকে একটি করে বিমান যুক্তরাষ্ট্রে যাবে এবং এই আড়াই হাজার জনের অস্থায়ী জায়গা হবে ফোর্ট লির সেনা ঘাঁটি।

নির্ভরযোগ্য সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বিপন্ন এমন আরও চার হাজার আফগানকে আশ্রয় দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে, কিন্তু তাদেরকে আপাতত অন্য কয়েকটি দেশে রাখা হতে পারে।

সেই লক্ষ্যে কাতার এবং কুয়েতে মার্কিন সেনা ঘাঁটিতে কয়েক হাজার আফগানকে কয়েক মাসের জন্য অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে ওই দুই দেশের সরকারের সাথে দেন-দরবার করা হচ্ছে। আমেরিকান কূটনীতিকরা কাজাখস্তান এবং কসোভোর সাথেও কথা বলছেন বলে জানা যাচ্ছে। তবে তৃতীয় দেশে আশ্রয়ের বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়।

বিপন্ন হাজার হাজার আফগান দোভাষী
কাবুলে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তারা কয়েকদিন আগেই বলছেন, দোভাষী বা মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য অন্যান্য নানা সময় কাজ করেছেন এমন ২০ হাজারের বেশি আফগান আমেরিকায় আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু তাদের অর্ধেকেরই ভিসার কাগজপত্র এখনও ধরাই হয়নি। কতজনকে শেষ পর্যন্ত ভিসা দেওয়া হবে, কতদিনে দেওয়া হবে তা অনিশ্চিত।

একইসঙ্গে পশ্চিমা বিভিন্ন এনজিও এবং মিডিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে যারা কাজ করছেন তারাও দেশ ছাড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট এবং নিউইয়র্ক টাইমসসহ বেশ কয়েকটি শীর্ষ আমেরিকান মিডিয়ার পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে লেখা এক চিঠিতে আফগান ওই সাংবাদিকদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

তালেবান যেভাবে নতুন নতুন জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে, তাতে ভয়ে সিটকে রয়েছেন তারা। বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে, তাদের অনেকে পরিবার নিয়ে লুকিয়ে থাকছেন।

মার্কিন সরকার বলছে, জীবন বাজি রেখে যারা তাদের জন্য কাজ করেছে তাদের প্রতি আমেরিকার দায়িত্ব রয়েছে। মার্কিন বাহিনীর দোভাষী এবং অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে এসে আশ্রয় ও পুনর্বাসনের জন্য বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ১০০ কোটি ডলারের একটি জরুরী তহবিল অনুমোদন করেছে। অতিরিক্ত ৮ হাজার আফগান যেন চলে আসতে পারে তার জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করার কথা বলা হয়েছে ওই বিলে।

কিন্তু তারপরও ২০ হাজার আবেদনকারীর কতজনকে বিবেচনা করা হবে তা নিয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হচ্ছে না। কারণ তাদের সবার আবেদন গৃহীত হলে, পরিবারের সদস্যসহ এক লাখের মত আফগানকে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে জায়গা দিতে হবে।

তাছাড়া, যে ২০ হাজারের মত আফগান আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন তাদের অনেকে বেশ আগেই হয় কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন, না হয় বিভিন্ন অভিযোগে চাকরি হারিয়েছেন। তাদের নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

কী করছে বাকি ন্যাটো দেশ
ন্যাটো দেশভুক্ত আর যেসব দেশ আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করেছে তারাও তাদের সহযোগী হিসাবে কাজ করা আফগানদের আশ্রয় দেওয়া নিয়ে তেমন কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পর আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি সেনা মোতায়েন ছিল ব্রিটেনের এবং শুধু দোভাষী হিসাবেই প্রায় ৩ হাজার আফগানকে বিভিন্ন সময় নিয়োগ দিয়েছে ব্রিটিশ বাহিনী।

কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আফগানিস্তানে কমান্ডার হিসাবে কাজ করা সাবেক কয়েকজন ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা। এ সপ্তাহেই কয়েকজন সাবেক সেনা কমান্ডার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক চিঠিতে দ্রুত আরও আফগান দোভাষীকে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, নিজের জীবনের জন্য উদ্বিগ্ন শত শত আফগানের আবেদনপত্র ‘অযৌক্তিকভাবে’ বাতিল বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

তারা লিখেছেন, ‘অনেক সাবেক দোভাষীর আবেদন প্রায় বিনা কারণে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আমরা এই নীতি পুন:বিবেচনার অনুরোধ করছি… আমরা চলে আসার জন্য আমাদের একজন সাবেক দোভাষীরও যদি তালেবানের হাতে মৃত্যু হয়, তাহলে এই জাতির জন্য তা হবে বড় একটি লজ্জা।’

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দফতর থেকে জানানো হয়েছে, ব্রিটিশ বাহিনীর জন্য কাজ করতো এমন আফগান এবং তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ২ হাজার ২০০ আফগানকে গত কয়েক বছরে ব্রিটেনে নিয়ে এসে পুনর্বাসন করা হয়েছে। আরও ৮০০ জনকে নিয়ে আসার প্রক্রিয়া চলছে।

কিন্তু সুলহা অ্যালায়েন্স নামে সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তাদের যে সংগঠনটি আফগান দোভাষীদের আশ্রয়ের জন্য আন্দোলন করছে, তারা বলছে- যেখানে ব্রিটিশ বাহিনীর দোভাষীর সংখ্যা ছিল তিন হাজারের মত, সেখানে দোভাষী এবং পরিবার মিলিয়ে ৮০০ জনকে আনার পরিকল্পনা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়াও, রান্নার কাজ বা মালির কাজ করেছেন এমন লোকজনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনাতেই রাখা হচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

তবে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বিভিন্ন গুরুতর অপরাধের জন্য যেসব আফগান কর্মচারীদের বরখাস্ত করা হয়েছে অথবা যারা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারেন বা যাদের অপরাধ ব্রিটেনের আদালতে অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে, তাদেরকে আশ্রয়ের জন্য কখনই বিবেচনা করা হবে না।

এদিকে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করেছিল ন্যাটো জোটভুক্ত এমন অন্য দেশগুলোর ওপরও তাদের জন্য কাজ করা আফগান দোভাষী ও কর্মচারীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য চাপ বাড়ছে। চাপের মুখে গত জুন মাসে জার্মানি জানায়, ২০১৩ সালের পর থেকে যে সব আফগান নাগরিক জার্মান সৈন্যদের জন্য কাজ করেছে তারা আশ্রয় চেয়ে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু প্রতিটি আবেদনপত্র যেভাবে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে তা নিয়ে ওই আফগান দোভাষীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।

নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেরও অভিযোগ উঠেছে, তাদের ভিসার আবেদনপত্র এতোই জটিল যে, যেসব আফগান তাদের জন্য একসময় কাজ করেছেন তাদের পক্ষে তা প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

আত্মগোপনে অনেক দোভাষী
এদিকে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি এতোই নাজুক হয়ে পড়েছে যে ভিসার আবেদন করতে পশ্চিমা দূতাবাসগুলোতে নথিপত্র নিয়ে যাওয়াই আফগানদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আফগানিস্তানে আমেরিকান বাহিনীর একজন ব্যাটালিয়ান কমান্ডার হিসাবে কাজ করেছেন মাইক জেসন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, আমেরিকান ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র নিয়ে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকার ভেতর নিয়ে কাবুলে আসা অনেক আফগানের জন্য প্রায় আত্মহত্যার শামিল।

জুন মাসে এক বিবৃতি দিয়ে তালেবান নেতৃত্ব আশ্বাস দেয় যে পশ্চিমা বাহিনীর সাথে কাজ করেছে এমন লোকজনের কোনো ভয় নেই। কিন্তু সেই আশ্বাসে আফগানরা শুধু নয়, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোও ভরসা পাচ্ছে না।

‘নো ওয়ান লেফট বিহাইন্ড’ নামে মার্কিন যে এনজিও আফগানদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে কাজ করছে, তাদের এক হিসাবে এখন পর্যন্ত পশ্চিমাদের হয়ে কাজ করা কমপক্ষে ৩০০ আফগান দোভাষী বা তাদের পরিবারের সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কাবুল আর কতদিন নিরাপদ থাকবে তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি মার্কিন একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যে কাবুলের পতন হতে পারে। ফলে যে হাজার হাজার আফগান শুধু জীবিকার জন্য পশ্চিমা সৈন্যদের সাহায্যে কাজ করেছেন, তারা প্রমাদ গুনছেন।

টিএম