আফগানিস্তানজুড়ে তালেবানগোষ্ঠীর অভিযানের জেরে প্রতিদিন বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। তাদের মধ্যে প্রতিদিন হাজার হাজার উদ্বাস্তু আশ্রয়ের আশায় ছুটে আসছেন রাজধানী কাবুলে।

গত জুলাই মাসেই জাতিসংঘ বলেছিল, বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পরই আফগানিস্তানে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্ত হয়েছেন ২ লাখ ৭০ হাজার আফগান। তবে বিবিসি জানিয়েছে, প্রকৃত বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা অনেক বেশি।  

তালেবানগোষ্ঠী ও সরকারি বাহিনীর সংঘাতে বাড়ি-ঘর-সহায়-সম্পত্তি-নগদ অর্থ সব হারিয়ে সদ্য তালেবান দখলকৃত অঞ্চলগুলো থেকে লোকজন কাবুলে ছুটে আসছেন এবং প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার ও উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, কাবুলে আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭২ হাজার শিশুও রয়েছে।

এসব আশ্রয়হীন মানুষ এখন খাবার, আশ্রয় ঔষধসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণ জোগাড় করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

কিন্তু এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো উপায়ও নেই; হয় তাদেরকে নিজেদের এলাকায় সম্ভাব্য মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে, নয়তো কাবুলে এসে এরকম দুর্দশার মধ্যে থাকতে হবে।

আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ কুন্দুজের রাজধানী কুন্দুজ শহর থেকে স্ত্রী ও অল্পবয়সী দু্ই কন্যা ও শিশুপুত্রসহ কাবুলে পালিয়ে এসেছেন আসাদুল্লাহ(৩৫)। কাবুলের উপকণ্ঠে অস্থায়ী এক শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন তারা।

আসাদুল্লাহ

সম্প্রতি কুন্দুজের দখল নিয়েছে তালেবানগোষ্ঠী। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালেবানগোষ্ঠীর যুদ্ধের সময় মর্টার গোলার আঘাতে তার বাড়িঘর-সঞ্চয় সব ধ্বংস হয়ে গেছে বলে বিবিসিকে জানান আসাদুল্লাহ।

বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি রাস্তায় হকারি করতাম, খাবার আর মশলা বিক্রি করতাম, কিন্তু তালেবানের হামলায় বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখানে আশ্রয় নিয়েছি।’

‘কাবুলে আসার পর দু’রাত স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছি। তারপর এই শিবিরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছি।’

আসাদউল্লাহর দুই কন্যা

‘এখন আমাদের হাতে রুটি কেনার টাকাও নেই। আমার সন্তানের জন্য ‍ওষুধ কিনবো, তার সাধ্যও নেই। আমরা আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইছি।’

একই শিবিরে আশ্রয় নেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বিবিসিকে জানান, তিনি উত্তরের শহর পুল ই খুমরি থেকে স্বামী এবং সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। তার স্বামী যুদ্ধে আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

‘আমাদের একটা সুন্দর জীবন ছিল; বোমা হামলায় আমরা আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখানে এসেছি। আমাদের এক কাপড়ে খালি হাতে চলে আসতে হয়েছে।’

এ বছরের শুরুতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে আসতে শুরু করলো, তখন থেকেই মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলো হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল যে, আফগানিস্তানের ভেতরে বাস্তচ্যূত মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে।

গত কয়েক মাস ধরে তালেবান এবং সরকারি বাহিনীর মধ্যে লড়াই অনেক তীব্র হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে ১৮টিরই দখল নিয়েছে তালেবান। সংঘাতে এ পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।

জাতিসংঘভিত্তিক সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, সংঘাত শুরুর পর থেকেই আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট শুরু হয়েছে এবং বর্তমানে তা চরমে পৌঁছেছে। দেশটিতে নিকট ভবিষ্যতে বিশাল মাত্রার মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে ডব্লিউএফপি।

ডেনমার্কভিত্তিক শরণার্থী সংস্থা ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের আফগানিস্তান শাখার পরিচালক জ্যারেড রাওয়েল বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব খবর আসছে তাতে আমরা দেখছি লোকজনের নানা ধরনের চিকিৎসার দরকার হচ্ছে, যৌন নির্যাতন বেড়ে গেছে, বেড়েছে পাচারের ঘটনা।’

তিনি বলেন, খাবার-আশ্রয়-স্বাস্থ্য এবং স্যানিটারি সুবিধা ছাড়াও নতুন শরণার্থী হওয়া এই লোকজনের নগদ অর্থ সহায়তাও দরকার।

আসাদুল্লাহ এখনও একটা আশার ওপর নির্ভর করেই সামনে তাকিয়ে আছেন, একদিন তিনি পরিবার নিয়ে আবার কুন্দুজে ফিরে যেতে পারবেন। আমরা কুন্দুজে ফিরে যেতে চাই, সেখানেই আমরা বাস করতে চাই। আমরা আশা করছি একদিন আমাদের দেশে শান্তি ফিরবে এবং দেশটা মুক্ত, স্বাধীন হবে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এসএমডব্লিউ