বিশ বছর আগে, ৯/১১’র সাত সপ্তাহ পর আমি ওসামা বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী শেষ সাংবাদিক ছিলাম। মার্কিন বোমা হামলার মাঝেই আমরা আফগানিস্তানে সাক্ষাৎ করেছিলাম। বিন লাদেন গর্ব করে বলেছিলেন যে, তিনি একটি ফাঁদ পেতেছেন; যা আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অপমানিত করবে— যেমনটি সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানের আলোচনা হতে পারে বলে পূর্বাভাসও দিয়েছিলেন।

দুই দশক পর বিন লাদেন মৃত, কিন্তু তার সেসব ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। শুধুমাত্র তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, সেগুলোই যে সত্যি হয়েছে বিষয়টি তেমন নয়।

আমেরিকানরা সম্ভবত তাকে খুঁজে বের করে এবং হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে পেরেছিল ভেবে কিছু ছোট ছোট সান্ত্বনা খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু দিন শেষে বড় যে চিত্র সেটি খুব বেশি ভরসা করার মতো নয়। আল-কায়েদা এখনও আফগানিস্তানে রয়ে গেছে এবং তাদের অনুসারীরা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান দেখিয়েছে, বিন লাদেনের অনুসারীদের খুঁজে বের করার চেয়ে তাদের ধারণাগুলো বেশি কট্টর।

আরও পড়ুন: বেঁচে আছেন আল-কায়েদা প্রধান জাওয়াহিরি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমারা এ থেকে পুরোপুরি শিক্ষাগ্রহণ গ্রহণ করেছে কি-না আমি নিশ্চিত নই। ১৯৯৭ সালে আফগানিস্তানের তোরা-বোরা পার্বত্যাঞ্চলের গুহায় আমি যখন প্রথমবারের মতো বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাৎ করি, তখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিগগিরই তাদের পরাশক্তির খেতাব হারাবে— যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান এবং চীনের সমন্বয়ে একটি জোটের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি; যা আমাকে অবাক করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এখনও পরাশক্তি রয়ে গেছে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় অংশটি আমার কাছে সত্য বলে মনে হচ্ছে। তালেবান সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ইরান। একই সঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছে, স্বীকৃতি ও সমর্থনের বিনিময়ে মুসলিম উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনা অপরাধ ক্ষমা করতে ইচ্ছুক তারা।

আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে চীন ইতোমধ্যে ৩১ মিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। বিন লাদেন বুঝতে পেরেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি তার শত্রুদের সাধারণ স্বার্থ তৈরি করতে বাধ্য করবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শক্তিও আমেরিকার এক ধরনের দুর্বলতা।

৯/১১’র পর আমি ইরাক থেকে সিরিয়া এবং লেবানন থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত যুদ্ধের সংবাদ পরিবেশন করেছি। বিন লাদেন অনেক মুসলিমের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন— আর এটা শুধুমাত্র ধর্মীয় মতাদর্শের কারণেই নয়, বরং ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্ব এবং ইসলামি বিশ্বের পুতুল সরকারগুলোকে ওয়াশিংটনের সমর্থনের জন্য।

আরও পড়ুন: আফগান সৈন্যের মাথা কেটে নেচে-গেয়ে উল্লাস

আমি ৯/১১’র পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল, কন্ডোলিৎজা রাইস, হিলারি ক্লিনটন, জন এফ. কেনেডি এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপক সাফল্য দাবি করেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ যে আরও সন্ত্রাস সৃষ্টি করছে সেবিষয়ে তারা অবগত ছিলেন না বলে মনে হয়েছিল। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট আঘাতের একমাত্র উদাহরণ ইসলামিক স্টেট।

এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, ৯/১১’র পর যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে আল-কায়েদা, তালেবান এবং ইসলামিক স্টেটের অনেক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। তবে এটাও সত্য, সেসব হামলার সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির ফলে শত শত নতুন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীও তৈরি হয়েছিল। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর বিরুদ্ধে এই আত্মঘাতী হামলাকারীরাই তালেবানের সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র হয়ে ওঠে। এখন তালেবান নিজেই ইসলামিক স্টেটের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের মুখোমুখি হচ্ছে।

ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচিত দোহা চুক্তি বাস্তবায়নে তালেবানকে বাধ্য করার মাধ্যমে লাদেনকে ভুল প্রমাণ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবানকে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রয়োগ করা উচিত যে, আফগানিস্তানকে অন্য কোনও দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না।

তালেবানের ক্ষমতা দখলে বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা খুশি নন, এটি সহজেই বোধগম্য। কিন্তু তাদের বুঝতে হবে, তারা উদ্দেশ্যসাধন থেকে এখনও পিছিয়ে আছেন। আফগানিস্তানের সম্পত্তি ফ্রিজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু দেশ পরিচালনার জন্য তালেবানের অর্থ দরকার। দেশের ক্ষমতা কাঠামোতে নারী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করতে তালেবানকে বাধ্য করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করা উচিত।

আরও পড়ুন: আফগানিস্তানের খাদ্য সংকট চরমে, বিপর্যয়ের মুখে ৯৩ ভাগ পরিবার

সামরিক শক্তি হয়তো কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু এতে সমস্যাই বেশি তৈরি হয়। বিন লাদেন সামরিক শক্তির ব্যাপক ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রকে উসকানি দিতে চেয়েছিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটি সমাধানের চেয়ে সমস্যাই বেশি তৈরি করবে। যদিও একটি দেশের স্বার্থ হাসিলের জন্য যুদ্ধই একমাত্র উপায় নয়।

অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করা উচিত হবে না ওয়াশিংটনের। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য প্রত্যাহারের পর এবার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে। যা আফগানিস্তানকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় এবং তালেবান সেই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফল। এখন এই দেশটি আরও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায় সর্বত্র ইসলামপন্থী জঙ্গিদের শক্তিশালী করবে; এই সত্য অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু তালেবান যদি আফগানিস্তানে শান্তি এবং নিরাপত্তা আনতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ফল আরও খারাপ হতে পারে। ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলো ওসামা বিন লাদেনের মতো মানুষের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘাঁটি। ১৯৯৬ সালে তিনি দুর্বল সুদান থেকে ব্যর্থ আফগানিস্তানে চলে যান এবং তারপর ৯/‌‌১১ হামলার পরিকল্পনা এগিয়ে নেন।

‌১৯৯৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাকে হত্যা করতে পারে; কিন্তু তাকে কখনও জীবিত ধরতে পারবে না। এটিও সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। চলুন তাকে আর অন্যান্য বিষয়ে সঠিক হতে না দিই।

• ওয়াশিংটন পোস্টে হামিদ মীরের লেখা নিবন্ধ। ভাষান্তর করেছেন সাইফুজ্জামান সুমন।

এসএস