আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পৃথিবীর ৭০ ভাগ মানুষকে কোভিডের টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার করতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। করোনা টিকা আবিষ্কারের পর থেকে বিশ্বের ধনী দেশগুলো নিজেদের জন্য বিপুল পরিমাণ ডোজ কিনে মজুত করে রেখেছে; যার পরিমাণ তাদের প্রয়োজনের তুলনা অনেক বেশি। মজুত এই টিকার বিশাল এক অংশ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফেলে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইরানের নাগরিক বাহার চলতি বছর গ্রীষ্মকালে দেশে যাওয়ার জন্য বিমানে উঠেছিলেন। চার বছর পর প্রথমবারের মতো তার বাবার সাথে আবার দেখা হবে— এমন ভাবনায় উন্মুখ ছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় তার কোনও ধারণাই ছিল না— করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ কীভাবে তার পরিবার এবং পুরো দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে।

প্রথমে আক্রান্ত হন তাদের এক পারিবারিক বন্ধু— যিনি তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। তারপর প্রাণ হারিয়েছেন বাহারের বাবার চাচা ও একজন বৃদ্ধ চাচি।

বাহারের তখন দুশ্চিন্তা দেখা দিল তার দাদকে নিয়ে— তিনি মাত্র এক ডোজ টিকা নিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বাহারের বয়স ২০ বছর এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। গত এপ্রিলে কোভিডের টিকা নিয়েছেন তিনি।

নিজে সুরক্ষিত জেনেও যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার আগের কয়েকদিন তার বাবার বাড়িতে ছিলেন তিনি; অন্য কোথাও যাননি। কিন্তু সব সময়ই তার এই চিন্তা ছিল, ভাইরাস এরপর কাকে আক্রমণ করবে।

ইরান এমন একটি দেশ যেখানে খুব কম মানুষই করোনাভাইরাসের টিকা পেয়েছেন— কারণ সরবরাহ খুবই কম। বাহারের পরিবারের মাত্র অল্প কয়েকজন সদস্য টিকা নিয়েছেন।

বেঁচে থাকার অপরাধবোধ

যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার কয়েকদিন পর তিনি জানতে পারেন, তার বাবা অসুস্থ। এতদূর থেকে তিনি খুবই ভীত হয়ে পড়লেন। এটা হচ্ছে অনেকটা নিজে বেঁচে যাওয়ার অপরাধবোধ— বলছিলেন বাহার।

‘আমি দুই ডোজ ফাইজারের টিকা নেওয়ার ফলে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ইরান ত্যাগ করেছিলাম।’ বাহারের পিতা সেরে উঠেছিলেন, তবে তার অন্য অনেক বৃদ্ধ আত্মীয় মারা গেছেন। তিনি বলেন, এটা জানার পর তার মনে অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়েছে।

বিরাট অসাম্য

টিকার ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এখন যে অসাম্য পরিসংখ্যানে ফুটে ওঠে— তা বিরাট। পৃথিবীর অর্ধেকের সামান্য বেশি মানুষ এখনও এক ডোজ টিকাও পাননি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, পৃথিবীতে যত কোভিড টিকা উৎপাদিত হয়েছে, তার ৭৫ শতাংশই গেছে বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশে। ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বলছে, এখন পর্যন্ত উৎপাদিত ভ্যাকসিনের অর্ধেকই গেছে পৃথিবীর জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশের কাছে।

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোতে টিকা দেয়া হয়েছে দরিদ্র দেশগুলোর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি।

দরিদ্র দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি টিকা

গত জুনে জি-সেভেনের সদস্য— কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছে যে আগামী এক বছরে দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি ডোজ টিকা দান করা হবে। সাবেক কূটনীতিক, টিকা সরবরাহ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের প্রণেতা ও ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্সের আগাথা ডেমারাইস বলেন, ‘আমি খবরটা দেখে হেসেছিলাম। আমি এ রকম অনেক দেখেছি, আমি জানি এটা কখনোই হবে না।’

যুক্তরাজ্য অঙ্গীকার করেছিল তারা দেবে ১০ কোটি টিকা, এখন পর্যন্ত তারা ৯০ লাখেরও কম দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, তিনি ৫৮ কোটি টিকা দান করবেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত দিয়েছে ১৪ কোটি। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২৫ কোটি টিকা দেওয়ার কথা বললেও এখন পর্যন্ত সরবরাহ করেছে তার মাত্র ৮ শতাংশ।

ইরানের মতো অনেক মধ্য আয়ের দেশ কোভ্যাক্স থেকে টিকা কিনেছে— যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থিত একটি উদ্যোগ। কোভ্যাক্স মধ্য আয়ের দেশগুলোর কাছে কম দামে টিকা বিক্রি করবে এবং দরিদ্র দেশগুলোকে বিনামূল্যে দান হিসেবে দেবে; এটাই ছিল পরিকল্পনা।

২০২১ সালে কোভ্যাক্সের পরিকল্পনা ছিল ২০০ কোটি টিকা সরবরাহ করা, যা আসার কথা ভারত থেকে। কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মক চেহারা নেওয়ার পর ভারত সরকার টিকা রফতানি নিষিদ্ধ করে।

টিকা সরবরাহে এই গুরুতর বিঘ্নের পর কোভ্যাক্স মূলত ধনী দেশগুলোর দানের ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু সরবরাহের গতি অত্যন্ত ধীর। কোভ্যাক্সের টিকা পাওয়া কিছু দেশ এখনও তাদের জনসংখ্যার ২ শতাংশকেও টিকা দিতে পারেনি।

কোভ্যাক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওরেলিয়া এনগুয়েন বলছেন, বর্তমানে খুব কম পরিমাণে টিকা শেয়ার হচ্ছে এবং তাদের যে সময় সীমা অর্থাৎ এক্সপায়ারি ডেটের মধ্যে ব্যবহার করতে হবে; সেই সময়সীমাটাও সংক্ষিপ্ত। এ কারণে টিকাগুলো একটা দেশে পাঠানোর কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এয়ারফিনিটি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা সারা বিশ্বের সরবরাহ সমস্যা নয়। ধনী দেশগুলো তাদের হাতে অতিরিক্ত টিকা মজুত করে রাখছে। টিকা উৎপাদনকারীরা এখন প্রতিমাসে দেড়শ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করছে এবং এ বছরের শেষ নাগাদ ১ হাজার ১০০ কোটি টিকা উৎপাদিত হবে।

এয়ারফিনিটির গবেষক ড. ম্যাট লিনলি বলছেন, তারা বিপুল পরিমাণ টিকা উৎপাদন করছে এবং গত তিন-চার মাসে উৎপাদন ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর হাতে ১২০ কোটি ডোজ টিকা থাকবে, যা বুস্টার টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আসলে দরকার হবে না।

ড. লিনলি বলছেন, এই টিকার প্রায় এক পঞ্চমাংশ—২৪ কোটি ১০ লাখ টিকা এখন ফেলে দেওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যদি না তাদের অতি শিগগিরই অন্য দেশগুলোকে দান করা হয়। এমন সম্ভাবনা আছে যে দরিদ্র দেশগুলো এসব টিকা গ্রহণ করবে না— যদি না এগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগে অন্তত দুই মাস সময় থাকে।

তিনি বলেছেন, ধনী দেশগুলো লোভের কারণে এত টিকা কিনে রেখেছিল এটা আমি মনে করি না। আসলে কোন টিকায় কাজ হবে তা তখন তারা জানতো না, ফলে তারা কয়েক রকম টিকা কিনতে বাধ্য হয়েছিল।

তবে এয়ারফিনিটি বলছে, এখন টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ পরিস্থিতি যে রকম— তাতে অতিরিক্ত টিকার মজুত করে রাখার কোনও দারকার নেই। বরং তারা সেই অতিরিক্ত টিকা অন্য দেশকে দান করে দিতে পারে। বিবিসি বাংলা।

এসএস