উপসাগরীয় কোনো দেশের নৌবাহিনী, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত ইসরায়েলি রণতরীর সাথে যৌথ নৌ মহড়া চালাচ্ছে এমন ঘটনা এই প্রথম। মাত্র তিনবছর আগেও বিষয়টা ছিল অচিন্ত্যনীয়। লোহিত সাগরে পাঁচ দিনের এই নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, ইসরায়েল ও মার্কিন রণতরীগুলো।

এই মহড়া শুরু হয়েছে গত বুধবার এবং ‘জাহাজের মুক্ত চলাচল নিশ্চিত করতে’ জাহাজে ওঠা, অনুসন্ধান চালানো এবং তা জব্দ করার কৌশল এই মহড়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মার্কিন নৌবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড বলছে, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বাড়াতে যৌথভাবে কাজ করতে অংশ গ্রহণকারী দেশগুলোর নৌবাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি এই প্রশিক্ষণের লক্ষ্য।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আরব আমিরাত এবং বাহরাইন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে অ্যাব্রাহাম চুক্তি নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করার পর এই যৌথ মহড়ায় দেশগুলো অংশ নিচ্ছে। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইসরায়েল এবং উপসাগরীয় দেশ দু’টির মধ্যে কূটনৈতিক, সামরিক এবং গোয়েন্দা যোগাযোগের ব্যাপারে ব্যাপক ভিত্তিতে আলাপ আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে ইরান বিষয়ে এই দেশগুলোর একই ধরনের উদ্বেগের পটভূমিতে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রধান নিজে বাহরাইনে গেছেন এবং অক্টোবর মাসে ইউএই-র বিমান বাহিনীর অধিনায়ক প্রথম বারের মত এ ধরনের একটি সফরে ইসরায়েল গেছেন।

ইরান যেভাবে তার শক্তি বৃদ্ধি করেছে
ইরানও সম্প্রতি হরমুজ প্রণালীতে তাদের নিজস্ব নৌ মহড়া চালানোর ঘোষণা দিয়েছে। উপসাগরীয় এলাকায় মার্কিন এবং অন্যান্য পশ্চিমা নৌবাহিনীর উপস্থিতির ঘোর বিরোধিতা করছে ইরান।

শাহ-এর শাসনামলে ওই এলাকায় নৌ সামরিক শক্তিতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ ছিল ইরান। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর উপসাগরীয় আরব দেশগুলো থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীকে বহিষ্কারের জন্য প্রায়শই আহ্বান জানিয়েছে তেহরান।

ইরান আরব দেশগুলোকে বলার চেষ্টা করেছে যে, উপসাগরীয় এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য স্বাভাবিকভাবে ইরানের সাথেই জোটে তাদের অংশীদার হওয়া উচিত। কিন্তু ইরানের এই আহ্বানে তারা কর্ণপাত করেনি। ছয়টি আরব রাষ্ট্রের প্রত্যেকেই যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশে সামরিক ঘাঁটি তৈরির কাজ চালিয়ে যেতে দিয়েছে।

মূলত ইরান ও তার ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) সম্পর্কে গভীরভাবে সন্দিহান সৌদি আরব, বাহরাইন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইরান আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সফলভাবেই অগ্রাহ্য করে যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী বিকল্প মিলিশিয়া বাহিনীর নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, তার ওপরেও তারা উদ্বেগের সাথে নজর রেখেছে।

সৌদি নেতৃত্বে ইয়েমেনে হামলা
সৌদি নেতৃত্বে ইয়েমেনের ওপর ছয় বছরের বেশি সময় ধরে চালানো বিমান হামলা ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুথি বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে পারেনি। লেবাননে হিজবুল্লাহ আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

ইরাক-সিরিয়াতে মিলিশিয়াদের অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিয়ে এবং সিরিয়াতে তাদের নিজস্ব বাহিনী পাঠিয়ে ইরান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ প্রশাসনের হাত শক্ত করে এই দুটি দেশে তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করেছে।

ইরান তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভার আরও উন্নত করেছে এবং এসব ক্ষেপণাস্ত্র উপসাগরের যেকোন জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম। রেভল্যুশনারি গার্ডের নৌবাহিনীও দ্রুত তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে তাদের নৌ অস্ত্র সম্ভারে যুক্ত করেছে দ্রুত আঘাত হানার এবং মাইন পাতার উপযোগী জাহাজ।

উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর উদ্বেগের সাথে সহমত ইসরায়েল। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে তারা ক্রমশই আরও বেশি উদ্বিগ্ন উঠছে। বিশেষ করে ২০১৫ সালে তথাকথিত যৌথ সার্বিক কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) নামে যে পরমাণু চুক্তি হয়েছিল, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পরে ইরান সেই চুক্তির প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার পর।

ইসরায়েলের সন্দেহ- ইরান পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে। যা ইরান অস্বীকার করে আসছে।

রহস্যজনক হামলা
ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে অঘোষিত একটা চাপা নৌ সংঘাতও চলেছে সাম্প্রতিক সময়ে। এমনকি লোহিত সাগর এবং ওমান উপসাগরেও জাহাজের ওপর রহস্যজনক হামলা হয়েছে।

গত জুলাই মাসে ওমান উপকূলের অদূরে ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি তেলবাহী জাহাজের ওপর একটি বিস্ফোরক ভর্তি ড্রোন হামলায় একজন ব্রিটিশ নিরাপত্তা রক্ষী ও একজন রোমানিয়ান নাবিকের মৃত্যুর জন্য ইরানকে দায়ী করা হয়েছে। ইরান এই ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের কার্যকলাপের নিন্দা জানানোর ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে সোচ্চার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব। বিশেষ করে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আল সাউদ ২০১৫ সালে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সৌদি ইরানের সমালোচনায় আরও মুখর হয়েছে।

তবে ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঘটা একটি ঘটনা রিয়াদে কৌশল পরিকল্পনাকারীদের সব হিসাব নিকাশ আমূল বদলে দেয়। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগে অন্ধকারের মধ্যেই সৌদি আরবের আবকেইক ও খুরাইশে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিশোধন স্থপনার ওপর এসে আঘাত হানে সুনির্দিষ্ট নিশানায় ছোঁড়া এক ঝাঁক ড্রোন ও মিসাইল। ওই একটি মাত্র হামলায় সৌদি আরবের তেল উৎপাদন সাময়িকভাবে অর্ধেকে নেমে যায়।

ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা হামলার দায় স্বীকার করে। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোঁড়া হয়েছিল উত্তর দিক থেকে এবং পরে তদন্তে জানা যায় সীমান্তের অপর পারে দক্ষিণ ইরাক থেকে ইরানের প্রক্সি মিলিশিয়ারা ওই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছুঁড়েছিল।

ইরানের স্পষ্ট বার্তা
ইরানের পক্ষে বার্তাটা ছিল স্পষ্ট: ইরান চাইলে সৌদি আরব এবং তার মিত্র দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম, যার মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পানি লবণ-মুক্ত করার স্থাপনা এবং অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্রগুলো।

সৌদি আরব সেই হামলার জবাব দিতে মুখর হয়ে ওঠেনি, যেটা ছিল উল্লেখযোগ্য এবং সাম্প্রতিক কয়েক মাসে ইরানি এবং সৌদি কর্মকর্তারা উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কথাবার্তা বলেছেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তেহরান আর রিয়াদ তাদের মধ্যে সহসা একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে।

এর অর্থ হল ভবিষ্যতে কোনো সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দুই দেশই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা স্বীকার করে নেওয়া। এছাড়াও তাদের মধ্যে বিভেদ সত্ত্বেও ওই অঞ্চলে একটা স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা মেনে নিয়ে একটা সমঝোতার পথ বের করার গুরুত্ব অনুধাবন করা।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম