যাজকের মেয়ের জার্মান শাসনের গল্প
জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। তার পিতা হাস্ট কাসন ছিলেন হামবুর্গের একটি গির্জার ধর্মযাজক। সেই যাজকের মেয়ে শুধু জার্মানিরই না; পুরো ‘ইউরোপের ক্রাইসিস ম্যানেজার’। সর্বত্রই তার সমান প্রভাব।
বিশ্ব রাজনীতিতে একটি শ্রুতিকথা আছে- ‘পৃথিবীতে একজনই মেরকেল আছেন’। করোনা মহামারির আগে বা করোনাকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে ‘অ্যাঙ্গেলা মেরকেল’ অন্যতম আলোচিত নাম।
বিজ্ঞাপন
জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ) চেয়ারপারসন মেরকেল। ২০০৫ সাল থেকে জামার্নির চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে মেরকেল নিঃসন্তান হলেও কাজ করেছেন সারা বিশ্বের শিশুদের জন্য। বিখ্যাত সাময়িকী ‘ফোর্বস’র তালিকায় অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বরাবর-ই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের মধ্যে শীর্ষেই থাকেন। জার্মানির অর্থনীতি আর রাজনীতিতে সাহসের সঙ্গেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পর চ্যান্সেলর হিসেবে অবসর নিতে চলেছেন মেরকেল। তার মতো তুখোড় ও কম বিতর্কিত নেতার শূন্যস্থান পূরণ দেশটির জন্য যথেষ্ট কঠিন হবে।
তবে জার্মানি ও জার্মানির বাইরে অর্থ্যাৎ বিশ্ব রাজনীতিতে মেরকেলের ভূমিকা অনেক। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) সক্রিয় এবং কার্যকর রাখতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ফোর্বস বেশ কয়েকবার-ই অ্যাঙ্গেলা মেরকেলকে সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। মেরকেল রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায় আসেন ২০০৫ সালে। এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ফোর্বসের তালিকায় চারবার সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় ছিলেন শীর্ষে।
দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্বপালনকালে পাঁচ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন মেরকেল। দেখেছেন চার ফরাসি প্রেসিডেন্ট, সাত ইতালিয়ান প্রধানমন্ত্রীকে। জো বাইডেন গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেছেন। অর্থ্যাৎ বাইডেন ৪র্থ মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যার সঙ্গে মেরকেলের কাজ করার অভিজ্ঞতা হবে।
এ সময় জাপানেও পালাবদল হয়েছে আট প্রধানমন্ত্রীর। বিশ্বের অনেক নেতা এসেছেন, আবার চলেও গেছেন। কিন্তু জার্মানির মেরকেল ছিলেন।
জার্মানির ক্ষমতাসীন দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ)-এর নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আরমিন লাশেট (৫৯)। বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই নেতা বর্তমানে দেশটির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী। এলাকাটি বিদেশী অধ্যুষিত।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের অপ্রকাশিত কিছু গুণ
রাশিয়ান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন:
১৯৫৪ সালে ১৭ জুলাই জার্মানির হামবুর্গে জন্মগ্রহণ করেন মেরকেল। জন্মের ছয় সপ্তাহ বা দেড় মাস পরে মেরকেলের পরিবারকে হামবুর্গ থেকে তৎকালীন সোভিয়েত-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব জার্মানিতে সরিয়ে নেন। জিডিআর-এ বেড়ে ওঠা অন্য শিশুদের মতো শিশু মেরকেলও শিখতেন রাশিয়ান ভাষা। তিনি পূর্ব জার্মানির রাশিয়ান ভাষা প্রতিযোগিতায় তিনবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বারটেন্ডার ছিলেন:
জার্মানির লেইপজিগের কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পদার্থ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন। কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালয়টিই বর্তমানে লিপজিপ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে অধ্যয়নকালে মেরকেল ছাত্র ডিসকোতে বারমিডের পক্ষে কাজ করেছিলেন। তিনি নিজে একটি অনুষ্ঠানে এই কথা জানান।
বার্লিন প্রাচীরের পতন উদযাপন:
১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর জার্মানিতে ৪০ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের সমাপ্তি হয়। সেসময় ৩৫ বছর বয়সী মেরকেল বার্লিন প্রাচীন পতনের রাতে উদযাপন করেছিলেন আনন্দের সঙ্গে।
প্রথম স্বামীর নাম মুছেননি:
১৯৫৪ সালে জন্মগ্রহণের পর তার নাম ছিল অ্যাঙ্গেলা কাসনার। কিন্তু কার্ল মার্কস বিশ্ববিদ্যালইয়ে পড়ার সময় ১৯৭৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানী উলরিচ মেরকেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তিনি হন অ্যাঙ্গেলা মেরকেল। তাদের এই সংসার স্থায়ী হয়েছিল প্রায় পাঁচ বছর। বিবাহ বিচ্ছেদের পর নিজের পূর্বের নামে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে প্রথম স্বামীর নামই নিজের নামে বহাল রাখেন মেরকেল।
অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের দ্বিতীয় স্বামীর নাম জোয়াচিম সাউয়ের। তিনি বার্লিনের হাম্বল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। জার্মান গণমাধ্যম তাকে ‘দ্য ফ্যান্টম অফ দ্য অপেরা’ বলে সম্বোধন করে।
যেমন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক, তেমনি পারদর্শী রান্নায়ও:
একজন দক্ষ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল যেমন সবার কাছে সুপরিচিত, তেমনি রান্নার ক্ষেত্রে তিনি সমান পারদর্শী। এমনকি মেরকেল তার রান্নার দক্ষতায় গর্বও অনুভব করেন। বিশেষ ধরনের কেক বানানোয় তার খ্যাতিও রয়েছে।
চ্যান্সেলর হলেও বার্লিনে নিয়মিত সুপারমার্কেটে শপিং করেন মেরকেল। তিনি একবার নাইজেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনকে বলেছিলেন যে- তিনি যেন প্রতিদিন সকালে তার স্বামীর জন্য নাস্তা তৈরি করেন।
বাবার কথা হৃদয়ে গাঁথা:
১৯৯৫ সালে কুকুরের কামড়ের শিকার হয়েছিলেন মেরকেল। এরপর থেকে কুকুরকে মারাত্মক ভয় পান তিনি। কথিত আছে, চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলকে ‘ভয় দেখানোর উদ্দেশে’ একটি অনুষ্ঠানে নিজের পোষা কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এসময় পুতিনকে নিজের বাবার একটি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।
পুতিনকে মেরকেল বলেছিলেন, একদিন রাতে তার পিতা পোষা কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে বের হন। কিছু দূর এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান- এক পিতা তার বাচ্চাকে নিয়ে না খেয়ে রাস্তায় শুয়ে আছে। তিনি ভাবলেন- মানুষ না খেয়ে রাস্তায় শুয়ে আছে, আর আমি কুকুর লালন করি! এটা (কুকুর লালন) এক ধরনের বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
পুতিনকে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমাকে খুব নাড়া দেয়।
টিএম