চলতি বছরের শেষ নাগাদ যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যা পৌনে চার লাখ ছাড়াতে পারে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সঙ্গে হুথি বিদ্রোহীদের চলমান এই সংঘর্ষে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা পৌছাতে পারে ৩ লাখ ৭৭ হাজারে।

মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) প্রকাশিত নতুন একটি রিপোর্টে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এই তথ্য সামনে এনেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।

জাতিসংঘ বলছে, তাদের অনুমিত এই প্রাণহানির সংখ্যার ৭০ শতাংশই হতে পারে শিশু, যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম। এছাড়া নিহতদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষই চলমান ইয়েমেন যুদ্ধের পরোক্ষ কারণ হিসেবে প্রাণ হারাতে পারেন। পরোক্ষ এসব কারণের মধ্যে রয়েছে ক্ষুধা এবং প্রতিরোধযোগ্য অসুখ ও রোগ। এছাড়া যুদ্ধের প্রত্যক্ষ যেসব কারণে মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন, তার মধ্যে রয়েছে উভয়পক্ষের সম্মুখ যুদ্ধ এবং বিমান হামলা।

ইউএনডিপির প্রশাসক আচিম স্টেইনার বলছেন, ‘ইয়েমেনে সম্মুখ সমরে নিহত মানুষের চেয়ে সংঘর্ষের পরোক্ষ কারণে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা বেশি বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

২০১৫ সালের শুরুর দিকে হুথি বিদ্রোহীদের হামলার মুখে সৌদি-সমর্থিত ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আব্দ রাব্বু মনসুর আল হাদি ক্ষমতা ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে যান। ক্ষমতাচ্যুত এই প্রেসিডেন্টকে ফেরাতে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

অভিযান শুরুর পর ইয়েমেনের রাজনৈতিক সংকটের অবসান হওয়ার পরিবর্তে তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে ইয়েমেনে কার্যত দুই শাসকগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক সহযোগিতার ওপর ভর করে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল এখনও মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে হুথি বিদ্রোহীরা।

এর আগে গত অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানায়, ছয় বছরের বেশি সময় আগে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের শুরু হওয়া হামলায় ইয়েমেনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার শিশু নিহত অথবা পঙ্গু হয়েছে। বিদ্রোহীগোষ্ঠী হুথিদের আক্রমণের মুখে ইয়েমেনের সরকারের পতনের পর ২০১৫ সালের মার্চে দেশটিতে সৌদি জোট অভিযান শুরু করেছিল।

অক্টোবরে ইয়েমেন সফর শেষে জেনেভায় ফিরে জাতিসংঘের এক বৈঠকে ইউনিসেফের মুখপাত্র জেমস এল্ডার জানান, ‘ইয়েমেন সংঘাত আরেকটি লজ্জাজনক মাইলফলকে পৌঁছেছে। দেশটিতে ২০১৫ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার শিশু নিহত অথবা পঙ্গু হয়েছে।’

এল্ডার সেসময় আরও জানান, ইয়েমেনে প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে চারজন অর্থাৎ মোট এক কোটি ১০ লাখ শিশুর জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি আরও চার লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে এবং ২০ লাখের বেশি শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। এছাড়া আরও অনেক শিশুর প্রাণহানি এবং আহতের খবর হিসেবের বাইরে রয়ে গেছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেনে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির কমপক্ষে ১ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ বর্তমানে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন।

ইয়েমেনের এই সংঘাতকে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ে সৌদি-ইরানের ‘ছায়াযুদ্ধ’ হিসেবে দেখা হয়। টানা গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত চলার ফলে প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এবং এক সময়ের স্বচ্ছল এই দেশটি।

টিএম