ছবি: নরেন্দ্র মোদির ফেসবুক পেজ

স্বাধীন ভারতের সামরিক ইতিহাসের সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার প্রথম সর্বাধিনায়ক ও সেনা বাহিনীর চিফ অব স্টাফ বিপিন রাওয়াতের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিককে হারিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

বুধবার নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা এক শোকবর্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জেনারেল বিপিন রাওয়াত একজন অসাধারণ সৈনিক ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আধুনিক করার ক্ষেত্রে তার ব্যাপক অবদান রয়েছে। সামরিক বিভিন্ন বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল ব্যাতিক্রমী ও উজ্জল। তার মৃত্যু আমাকে গভীরভাবে শোকাহত করেছে। ওম শান্তি।

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংও বিপিন রাওয়াতের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন। বুধবার এক টুইটবার্তায় রাজনাথ সিং বলেন, ‘তামিলনাড়ু হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় জেনারেল বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী ও ১১ জন সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুতে আমি বেদনাহত। তার (বিপিন রাওয়াত) এই অসময়ের মৃত্যুতে আমাদের সামরিক বাহিনী ও দেশের যে ক্ষতি হলো, তা কখনও পূরণ হবে না।’

বুধবার দুপুর দুইটার দিকে তামিলনাড়ুর মোইম্বাটোর জেলার কুনুর এলাকায় বিধ্বস্ত হয় ভারতের বিমান বাহিনীর এমআই-১৭ ভি৫ নামের একটি চপার হেলিকপ্টার। ওই হেলিকপ্টারেই ছিলেন বিপিন রাওয়াত, তার স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াত ও ভারতের সেনা বাহিনীর ১২ জন কর্মকর্তা।

বিপিন রাওয়াত ও তার স্ত্রী মধুলিকা রাওয়াত

ভারতের সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বল হয়, বুধবার বেলা ১১ টা ৪৫ মিনিটে তামিলনাড়ুর কোইম্বাটোর জেলার সুলুর শহরে ভারতের বিমান বাহিনীর ঘাঁটি থেকে থেকে রাজ্যের নীলগিরি পার্বত্য এলাকার ওয়েলিংটন শহরের দিকে যাচ্ছিল হেলিকপ্টারটি। ওয়েলিংটনে ভারতের সেনাবাহিনীর ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজের প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৬৩ বছর বয়সী রাওয়াত।

২০১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমল শুরু হওয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত প্রথম সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত। স্বাধীন ভারতের সামরিক ইতিহাসে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার সর্বাধিনায়ক হওয়ার কৃতিত্বও জেনারেল বিপিন লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়াতেরই।

১৯৫৮ সালের ১৬ মার্চ উত্তরাখণ্ডের পৌড়ীর এক গঢ়ওয়ালি রাজপুত পরিবারের জন্ম বিপিনের। তাঁর পরিবারে সেনাবাহিনীতে যোগদানের ইতিহাস পুরুষানুক্রমিক। বাবা লক্ষ্মণ সিংহ রাওয়াত ছিলেন ভারতীয় সেনার লেফটেন্যান্ট জেনারেল।

সেই রীতি মেনেই সেনায় যোগদান রাওয়াতের। শিমলার সেন্ট এডওয়ার্ড স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান মহারাষ্ট্রে পুণে জেলার খড়কভাসলার ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে। তারপর দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে যোগ দেন সেনার ১১ গোর্খা রাইফেলস ব্যাটালিয়নে।

দীর্ঘ কর্মজীবনের বড় অংশ জম্মু ও কাশ্মিরে কাটিয়েছেন রাওয়াত। কাশ্মিরের সোপোরে সন্ত্রাসদমন অভিযান থেকে রজৌরির নিয়ন্ত্রণরেখায় পাক হামলা প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। পেয়েছেন উত্তম যুদ্ধ সেবা মেডেল, পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেল-সহ একাধিক সেনা-সম্মাননা।

আফ্রিকার কঙ্গোয় জাতিসংঘের শান্তি কমিশনের একটি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। মেজর জেনারেল হিসেবে ১৮ নম্বর পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্বও পালন করেছেন।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রাওয়াত নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে সেনার ৩ নম্বর কোরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। তার পর হন পুণেতে দক্ষিণাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের প্রধান। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন।

প্রসঙ্গত, সেনাপ্রধান পদে রাওয়াতের পূর্বসূরি জেনারেল দলবীর সিংহ সুহাগ ২০১৪-র অগস্টে দায়িত্ব নিলেও তার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছিল মনমোহন সিংহ সরকারের জমানায়।

রাওয়াত সেনাপ্রধান থাকাকালে কাশ্মিরে পাথর ছোড়া ঠেকাতে এক বিক্ষোভকারীকে জিপে বেঁধে ঘুরিয়েছিল সেনা। সেই পদক্ষেপ সমর্থন করে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন তিনি। তার পর কাশ্মিরে বিক্ষোকারীদের পাথরে সেনাদের আহত হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘পাথরের বদলে ওরা যদি গুলি ছুড়ত, আমাদের পক্ষে মোকাবিলা করা অনেক সহজ হত।’

তিন বছর কাজ করার পর ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর স্থলসেনা প্রধানের অবসর নেওয়ার কথা ছিল রাওয়তের। তাঁর এক দিন আগে দেশের প্রথম সেনা সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে নিযুক্ত করে মোদী সরকার।

বিপিনের আগে ভারতের দুই প্রাক্তন সেনাপ্রধান- কে এম কারিয়াপ্পা এবং শ্যাম মানেকশকে অবসরের পর আলঙ্কারিক ভাবে ফিল্ড মার্শাল পদে উত্তীর্ণ করা হলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনার সমন্বয় রক্ষার দায়িত্ব পাননি। মোদী সরকার সেনা বিধি সংশোধন করে রাওয়াতকেই প্রথম তিন বাহিনীর ‘সিঙ্গল পয়েন্ট অ্যাডভাইজার’ পদে আসীন করেছিল।

জল্পনা ছিল, অবসরের আগে রাওয়াতকেও পাঁচতারা ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হতে পারে। জীবদ্দশায় সেই সুযোগ আর পেলেন না তিনি।

সূত্র: আনন্দবাজার, এনডিটিভি