করোনাভাইরাস তাণ্ডবে বিশ্ববাসী অবলোকন করেছেন নতুন এক বিশ্ব। সেখানে বদলে গেছে অনেক কিছু। গতানুগতিক জীবন ব্যবস্থায় এসেছে মোটা দাগের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের আঁচ পড়েছে চাকরির বাজারেও। দীর্ঘদিনের ব্যবসা, নয়টা পাঁচটা অফিসের কর্পোরেট জীবন এখন জুম বা গুগল মিটে সারতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা পরবর্তী চাকরির বাজারে আসবে আরও পরিবর্তন। যেখানে শুধুমাত্র যোগ্য এবং যোগ্য প্রার্থীরাই টিকে থাকবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, করোনাভাইরাস সংকটের কারণে বাংলাদেশে প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন হয়েছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ বেকারত্ব বাড়ছে। একই সঙ্গে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছেও। নিউ নরমাল চাকরির বাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে দরকার বেশ কিছু বাড়তি দক্ষতা। 

এরমধ্যে অন্যতম প্রযুক্তি দক্ষতা। করোনা পরবর্তী বিশ্বে চাকরির বাজারে টিকতে হলে আপনাকে অবশ্যই তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কেননা গত এক বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সব প্রতিষ্ঠানই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডাটা, ইন্টারনেট থিংস, ভার্চুয়াল এবং অগমেন্টেড রিয়েলিটি প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে । হিসাব কষে দেখা গেছে করোনার মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান এসব টুলস ব্যবহার করেছে  তারা অন্যদের তুলনায় ক্ষতির মুখোমুখি কম হয়েছে।  

বাংলাদেশের স্কুল কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক। দুই বছর আগেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছেলে মেয়েরা ভিডিও কলে ক্লাস করার কথা কল্পনাও করতে পারেনি। এখন সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা ভার্চুয়ালি ক্লাস করছে। এটি সম্ভব হয়েছে তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে। আগামীতে এই খাতে যারা ভালো করবেন, তারাই টিকে থাকবেন। এমনকি এখনকার প্রায় ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল করে প্রার্থীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা আছে কি না? কার্যত যে পদেই চাকরি করতে চান না কেন আপনাকে অবশ্যই প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। 

করোনা পরবর্তী চাকরির বাজারে টিকে থাকার আরেক হাতিয়ার হলো সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী দক্ষতা। গত বছর মহামারীর সময়ে রেসিং কার মার্সিডিজ এফ-১ থেকে শ্বাসযন্ত্রের সরঞ্জাম তৈরি করা হয়েছে। আরো অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বাভাবিক কার্যক্রমের বাইরে এসে নতুন নতুন প্রযুক্তি তৈরি করেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আন্দাজ করা যায়, প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যতে কর্মী নিয়োগের সময় পরখ করে দেখবেন, প্রার্থীর সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবন দক্ষতা কতটুকু আছে। 

টেকনিক্যাল বিষয়ে দক্ষতা থাকা চাই

টেকনিক্যাল বিষয়ে যার দক্ষতা যত বেশি, আগামীতে সে ততটাই ভালো করবে। কারণ করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পদ্ধতিতে চলছেনা, সেসব প্রতিষ্ঠান অনেকটাই বন্ধ হওয়ার পথে। করোনা পরবর্তী সময়েও প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল নির্ভরতা আরো বাড়বে। ফলে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল দক্ষতা, কোডিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে দক্ষরাই এগিয়ে থাকবে।

শুধু কি তাই? বলা হচ্ছে- আগামীর পৃথিবী হবে ডাটা নির্ভর। কিন্তু এই ডাটার কোনো অর্থ নেই যতক্ষণ না এটি কেউ সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করছেন। তাই সব প্রতিষ্ঠানই এমন প্রার্থীকে খুঁজছেন যিনি ডাটা বিশ্লেষণের পাশাপাশি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। বিষয়টি শুধুমাত্র চাকরি প্রার্থীদের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ  তেমনটি নয়। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ ডাটা বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপন জানেন না মানে আপনি অন্যদের তুলনায় কয়েকগুণ পিছিয়ে আছেন। 

জানাশোনা থাকতে হবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার সম্পর্কেও। ফেসবুক, টুইটার, লিংকডইন, ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিভিন্ন কোম্পানির বিজনেস ক্যাটাগরির সঙ্গে মিল রেখে নিয়মিত বিভিন্ন ফিচার আনছে। এসব মাধ্যম  ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানি কীভাবে তাদের প্রচার করে থাকে তা খেয়াল রাখুন। এগুলো আপনাকে চাকরি পেতে সহযোগিতা করবে।

ব্যতিক্রমী হয়ে উঠুন

করোনা পরবর্তী সময়ে চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতা সাধারণ সময়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি হবে। এক্ষেত্রে অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে পারলে চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠবেন। এজন্য সবার আগে আপনাকে অন্যের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। উদাহরণ হিসেবে আপনার সিভি এবং লিংকডইন প্রোফাইলকে ধরা যেতে পারে। 

পাশাপাশি সিভি এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যাতে নিয়োগকর্তা শর্টলিস্টে আপনাকে রাখতে বাধ্য হয়। সিভির প্রথম অংশে মার্জিত ও প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। যদি এটি না হয় তবে নিয়োগকর্তা কখনো দ্বিতীয় পৃষ্ঠা পড়বেন না। এমনকি লিংকডইনের প্রোফাইলে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সবার উপরেই থাকা উচিত। যাতে নিয়োগকর্তা আপনাকে খুঁজে পায় এবং মনে হয় আপনি একজন যোগ্য প্রার্থী।

একই ভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কথায় আছে, আত্মবিশ্বাস থাকলে অনেক কঠিন কাজও সহজ হয়ে যায়। অনেকেই আছেন বার বার ব্যর্থ হলে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এদিক থেকেও আপনাকে ব্যতিক্রমী হতে হবে। সব পরিবেশেই নিজেকে যোগ্য হিসাবে প্রমাণ করা চেষ্টা থাকতে হবে।

সাধারণত মাল্টি টাস্কার বা অনেক বিষয় পারদর্শী এমন প্রার্থীকে নিয়োগকর্তারা প্রাধান্য দেন। বর্তমানে একজন চাকরি-প্রার্থীকে অন্য প্রার্থীর থেকে এগিয়ে থাকতে হলে মাল্টি-টাস্কিং সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। আগে যে পদের জন্য নিয়োগ দেওয়া  হবে শুধু সেই পদের যোগ্যতা থাকলেই নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তা বদলে গেছে। এখন সংশ্লিষ্ট পদের যোগ্যতা ছাড়াও আইটি বা প্রযুক্তি সম্পর্কিত দক্ষতা থাকাটা সময়ের দাবি।

সবশেষ মনে রাখাতে হবে, চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে সবসময় সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণ বেশি হয়। তাই নতুন আবেদন করার সময় বাস্তববাদী হোন। কারণ আপনি না বুঝে যত বেশি চাকরির আবেদন করবেন, ততো বেশি প্রত্যাক্ষিত হবেন। তবে  দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপনি যে কাজে নিজেকে ফিট বলে মনে করেন, কেবল সেই সব কাজের জন্যই আবেদন করুন। এতে আপনার সফলতার হার বেড়ে যাবে। অন্যথায় আপনি কেবল নিজের সময় নষ্ট করছেন অথবা প্রত্যাখ্যানের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।  তাই যত্রতত্র আবেদন না করে, বুঝে শুনে আবেদন করতে হবে।