সোলায়মান সুখন। লাখো তরুণের প্রেরণার নাম। তার হাত ধরেই দেশে মোটিভেশনাল স্পিকিং বিষয়টি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ছিলেন নৌবাহিনীর কমিশন প্রাপ্ত অফিসার, পরে কাজ করেছেন স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান হিসেবেও। বর্তমানে ব্যস্ত করপোরেট জগতে। দায়িত্বে আছেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান নগদের চিফ পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার হিসেবে। সম্প্রতি তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্ট-এর সঙ্গে।

ঢাকা পোস্ট : মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে। সঙ্গত কারণেই আপনাকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। শুরুটা হোক ছেলেবেলার গল্প দিয়ে...

সোলায়মান সুখন : বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। সে সুবাদে আমার ছেলেবেলা কেটেছে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে। ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল দেশের আনাচে কানাচে। কখনো থেকেছি সাগর পাড়ের চট্টগ্রামে, কখনো পাহাড় ঘেরা সিলেটে। বাদ যায়নি উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুর কিংবা যশোরও। তবে লম্বা সময় কেটেছে ঢাকায়।

মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাই। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের স্মৃতি বলে শেষ করা যাবে না। ক্যান্টনমেন্টের মাঝে বাস্কেটবল গ্রাউন্ড, চারপাশে পাহাড়- এক কথায় অসাধারণ পরিবেশ। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের নিয়ে সি-বিচে ঘুরতে যাওয়া তো ছিলই।

উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই নৌবাহিনীতে যোগ দিই। অফিসার ক্যাডেট হিসেবে জয়েন করার পর আড়াই বছরের প্রশিক্ষণ নিই। এরমধ্যে এক বছর প্রশিক্ষণ ছিল যুদ্ধজাহাজে। পরে ২০০০ সালে নৌবাহিনীতে কমিশন পাই। এভাবেই আমার বেড়ে ওঠা।

ঢাকা পোস্ট : স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান ছিলেন একসময়। মঞ্চে মঞ্চে মানুষ হাসিয়েছেন। সেই অধ্যায়টা কেমন ছিল?

সোলায়মান সুখন : ২০১০ সালের দিকে নাভিদ মাহমুদ ও জারা মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরে নাভিদ ভাইয়ের স্ট্যান্ড-আপ কমেডি সম্পর্কে জানতে পারি। তখনো জানতামই না, আমিও লোক হাসাতে পারি। তবে বন্ধুদের আড্ডা কিংবা অফিস কলিগদের মাতিয়ে রাখতাম কথার জাদুতে। কিন্তু এই কাজটি যে প্রফেশনালিও করা যায়, সেটি আমার ধারণায় ছিল না। এটি নাভিদ ভাই আমাকে শিখিয়েছেন। তিনি আমাকে বিভিন্ন ওপেন মাইক সেশনে নিয়ে যান। 
বারিধারার ১২ নাম্বার রোড়ের বেইজমেন্টের স্ট্যান্ড-আপ কমেডিতেই আমার শুরু। আমি মূলত নিজের গল্পগুলোই বলতাম। বিশেষ করে আমার বেড়ে ওঠা, মিলিটারি একাডেমির হাস্যকর গল্প। আমার এখনো মনে আছে, ৯-১০ বছর আগে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে স্ট্যান্ড-আপ কমেডি করি। বেশি না, ১০-১৫ মিনিট কথা বলি। সে কথাগুলো কে যেন ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। সেটিই ছিল আমার প্রথম ভাইরাল ভিডিও। নিজের ভিডিও দেখে নিজেই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তবে বিভিন্ন কারণে পরবর্তীতে আর কমেডি করিনি।

ঢাকা পোস্ট : ব্যক্তি সোলায়মান সুখন তারকায় পরিণত হলো কীভাবে?

সোলায়মান সুখন : আমি শুরু থেকে জনবান্ধব কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করতাম। এর মধ্যেই নারী নির্যাতন নিয়ে আমার একটি বক্তব্য খুব ভাইরাল হলো। তারপর আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা আমাকে সমাজের আরো নানা ধরনের অসংগতি নিয়ে কথা বলতে অনুপ্রেরণা দিতে শুরু করলেন। ওখান থেকেই শুরু। শুরুতে ছোটখাটো অনিয়ম নিয়ে কথা বলতাম। একটু একটু করে জনপ্রিয়তা পেতে লাগলাম। যে কথাগুলো অন্যদের বলা উচিৎ বা বললেও ঘাবড়ে যেত সেগুলো আমি কিছুটা ভিন্নভাবে বলতে শুরু করলাম। একসময় আবিষ্কার করলাম, সফলদের সঙ্গে তরুণদের একটা দূরত্ব রয়েছে। সেজন্য বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করলাম। তাদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম। গত দশ বছর ধরে আমি নিয়মিত বিভিন্ন অনিয়ম ও অসংগতির বিষয় নিয়ে কথা বলছি। ফলে সাধারণ মানুষ আমাকে আপন করে নিতে শুরু করল। সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার ফলোয়ার সংখ্যাও বাড়তে থাকল। এইতো..।

ঢাকা পোস্ট : করপোরেট সেক্টরেও আপনি বেশ অভিজ্ঞ হয়ি উঠলেন। এ সম্পর্কে জানতে চাই..

সোলায়মান সুখন : তখন নৌবাহিনী থেকে সরে এসে নতুন করে দাঁড়ানোর চিন্তা করছি। এমন সময় আমার কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পরীক্ষা দিই। চান্সও পেয়ে যাই। এমবিএ করতে করতেই চাকরির চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। টেলিকম ও এসএমসি দুটো সেক্টরকে মাথায় রেখে পড়াশোনা শুরু করি। মার্কেটিংয়ে মেজর নিয়েই ২০০৫ সালের শুরুতে বেশ কয়েকটা এপয়েন্টমেন্ট লেটার পাই। পরে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোতে জয়েন করি। এতে সিলেট অঞ্চলের ট্রেড মার্কেটিং এবং ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ শুরু করি।

পরে বাংলালিংকে যোগ দিই। ২০১৩ সালে বাংলালিংক ছেড়ে একটা মোবাইল হ্যান্ডসেট ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছিলাম। বেশখানিকটা সফলও হই। যদিওবা সেটা ততোটা সাফল্যের মুখ দেখেনি। এরপর আরেকটি প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হতে হয় আমাকে। সেখানে থাকতেই ২০১৮ সালে নগদ থেকে ডাক পেয়েছিলাম, ঢুকেও গেলাম। এখনো নগদ-এ আছি।

ঢাকা পোস্ট : আপনি এখন ‘নগদ’ এ কর্মরত। প্রায়সময়ই দেখা যায় গ্রাহকরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছেন এই অনলাইন লেনদেনের মাধ্যমে। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?

সোলায়মান সুখন : নগদে প্রতিদিন সাড়ে সাতশ কোটি টাকার লেনদেন হয়। নগদ প্ল্যাটফর্ম পুরোপুরি গ্রাহকবান্ধব। আমাদের কল সেন্টার আছে, ফেসবুক পেইজেও উত্তর দিই। তবে ডিজিটাল প্রতারণা থেকে বাঁচতে গ্রাহকদের কিছুটা সচেতন হতে হবে।

যেমন পাসওয়ার্ড ও পিন কোড কাউকে দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশের মানুষ সহজ সরল। কেউ নগদের পরিচয়ে কল করে পিন চাইলেই দিয়ে দেয়! অথবা ওটিপি। বাস্তবতা হচ্ছে নগদ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কখনো ফোন করে এসব চাইবে না। গ্রাহকরা এই ব্যাপারে সচেতন হলেই প্রতারণার হার কমে যাবে। তাছাড়া কোনো প্রতারণার অভিযোগ পেলেই আমরা তাৎক্ষণিক আইনি পদক্ষেপ নিই। বাংলাদেশ পুলিশ এবং সাইবার ক্রাইম ইউনিট আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।

ঢাকা পোস্ট : ‘নগদ’ এ কোন কোন পদে নিয়মিত নিয়োগ দেওয়া হয়?

সোলায়মান সুখন : আমাদের সরাসরি পে-রোলে আছেন কয়েকশ মানুষ। ডিস্ট্রিবিউশন এবং ট্রেড মার্কেটিং টিমে কয়েক হাজার মানুষ কাজ করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি নিয়োগ দেওয়া হয় ডিস্ট্রিবিউশন সেলস অফিসার, ট্রেড মার্কেটিং ও কল সেন্টারে। তাছাড়া সেলস অফিসার ও ডিজিটাল মার্কেটিংয়েও নিয়মিত নিয়োগ দেওয়া হয়।

ঢাকা পোস্ট :  অনেকেই চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে। এর নেপথ্যে নানা কারণও আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সোলায়মান সুখন : তরুণরা চাকরি না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থীর যে ধরনের চাকরির প্রতি আগ্রহ, সে বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে। বিষয়ভিত্তিক পরিষ্কার ধারণা থাকা খুব জরুরি। এর সঙ্গে দুএকটা ভাষায় লিখতে ও কথা বলতে জানতে হবে। অফিস অ্যাপ্লিকেশনে কাজ জানা, দেশি ও আন্তর্জাতিক বিষয়সহ ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক। 

এছাড়া নিজেকে ভালোভাবে উপস্থাপন করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কোন সেক্টরে কাজ করবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার স্কিলের ওপরেই। বেসিক কিছু জিনিস খেয়াল রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারলে চাকরি পাওয়া খুব সহজ।

ঢাকা পোস্ট :  সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সোলায়মান সুখন : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ। অনেক অনেক শুভ কামনা।