বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সহকর্মীর কফিন কাঁধে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেনা কর্মকর্তারা

১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও বহুল আলোচিত রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের রায় কার্যকর করতে চূড়ান্ত আপিল শুনানির অপেক্ষা করতে হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে করা আপিল ও  মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল এখন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে, একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা এখনো নিম্ন আদালতেই বিচারাধীন রয়েছে।

তবে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আশা প্রকাশ করে বলেছেন, বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যা মামলার উভয়পক্ষের আপিল এ বছরই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী সর্বোচ্চ আদালতে হত্যাকাণ্ডের মামলার আপিল শুনানি ও নিম্ন আদালতে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রধান বিচারপতির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ২০২১ সালে আপিল দায়ের করেছি। কিছু আসামিকে অপর্যাপ্ত শাস্তির বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছি। খালাসের বিরুদ্ধে আমরা আপিল করেছি। অন্যদিকে, যারা মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন দণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি পেয়েছেন তারাও আপিল করেছেন। সবগুলো আপিল একসঙ্গে শুনানি হবে। সেক্ষেত্রে  আশা করছি এ বছরই শুনানি শুরু হবে। শুনানি শুরু হলে দুই সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হবে। 

হত্যাকাণ্ডের দিন পিলখানায় টহলরত বিডিআর জওয়ানরা

এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলা শুনানির জন্য স্পেশাল কোর্টের প্রয়োজন হবে না। আপিল বিভাগে যারা আছেন তারাই শুনবেন। উনারা হয়তো নির্দিষ্ট একটা সময় বেঁধে দিয়ে শুনানি করবেন। আশা করছি এ বছরই শুনানি শুরু হবে এবং এ বছরই আপিল শুনানি নিষ্পত্তি হবে। 

আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি ৮২ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ও ১০২ জন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে খালাস চেয়ে আপিল দায়ের করেছি। এতদিন শুনানি হয়নি। এতদিন আপিল  বিভাগে বিচারকের স্বল্পতাও ছিল। এখন বিচারপতি সংকট কেটেছে। আশা করি মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপিলগুলো দ্রুত শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

তিনি বলেন, এ ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলায় দ্রুত নিষ্পত্তি করতে সরকার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দেখিনি। হত্যা মামলা থেকে ২৬৯ জন আসামি বিভিন্নভাবে খালাস পেয়েছেন। এই মামলায় দেড়শর মতো আসামিকে ১০ বছরের সাজা দিয়েছিল। ইতোমধ্যে তাদের সাজা শেষ হয়েছে। ফলে এখন ৩০০ জনের মতো মানুষ কারামুক্তির অপেক্ষায়। আজ ১৩ বছর ধরে এই আসামিদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক মামলা থাকার কারণে তারা মুক্তি পাচ্ছেন না। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাতে ১২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২০০ জন সাক্ষীকে তারা আদালতে উপস্থিত করতে পেরেছে। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন জানাই। 

২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলায় নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জনের মধ্যে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯  জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বড় এ মামলার ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়।

রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামিকে যাবজ্জীবন এবং চারজনকে খালাস দেন আদালত। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড নেতা তোরাব আলীসহ ১২ জনকে খালাস দেন আদালত।   

বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিশেষ হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার। 

এছাড়া বিচারিক আদালতে তিন থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ২৫৬ আসামির মধ্যে ১০ বছরের কারাদণ্ডের আসামি ১২৮ জন, ৮ জনকে সাত বছর, চারজনকে ৩ বছর এবং ২ জনকে ১৩ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২৯ জন খালাস পান। ২৮ জন আপিল করেনি। ৩ জন মারা গেছেন।

এদিকে বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ জনের মধ্যে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৪ জনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট, এছাড়া ৩৪ জনকে খালাস দেন। দুই দিনব্যাপী উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

২০১৫ সালে এ মামলায় বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য  বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয়। 

এই বেঞ্চে ৩৭০ কার্যদিবস আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি হয়। ওই সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ বিভিন্ন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের সদর দপ্তরে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান। ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। বিচার হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন আলিয়া মাদ্রাসা মাঠসংলগ্ন অস্থায়ী এজলাসে। বিচার শেষে ঢাকা মহানগর তৃতীয় বিশেষ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বিডিআরের প্রাক্তন ডিএডি তৌহিদসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া বিএনপি দলীয় প্রাক্তন সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু (প্রয়াত) ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ২৭৭ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

এমএইচডি/এইচকে